০১:০৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৫ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অন্যের বাড়িতে কাজ করেন মা, মেয়ে জিতলেন সোনা

  • Voice24 Admin
  • সময়ঃ ১২:১৭:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ৫৪৩ Time View

পল্টন হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের অস্থায়ী কুস্তি ম্যাটে একে একে আনসারের রোজিনা আক্তার ও পুলিশের সুবর্ণাকে কুস্তির প্যাঁচে ধরাশায়ী করলেন রাজশাহীর জেমি আক্তার। ততক্ষণে সোনার পদকও নিশ্চিত হয়ে গেছে তার।

তারুণ্যের উৎসব উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ কুস্তি ফেডারেশন আয়োজিত দুই দিনব্যাপী ‘ভিসতা ১৩তম জাতীয় সার্ভিসেস কুস্তি’ শেষ হয়েছে সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর)। এতে মহিলা বিভাগের ৭৬ কেজি ওজন শ্রেণিতে সোনা জিতেছেন জেমি।

বাবার চেহারা কেমন সেটা মনে নেই জেমির। থাকবে কী করে? জেমির জন্মের আগেই যে মারা যান! মা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন অন্যের বাড়িতে।

রাজশাহীর সেই সাধারণ গৃহপরিচারিকার ঘামে ভেজা দিনগুলো কুস্তির মঞ্চে জন্ম দিয়েছে এক অসাধারণ স্বপ্নের। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালানো সেই মায়ের মেয়ে জাতীয় সার্ভিসেস কুস্তি প্রতিযোগিতায় জিতে নিয়েছেন সোনার পদক। মায়ের সংগ্রাম আর মেয়ের দৃঢ়তায় লেখা এই গল্প শুধু কুস্তির মঞ্চেই নয়, হৃদয়ের মঞ্চেও এক অনন্য জয়গাথা।

রাজশাহীর অচেনা এক গলিপথের ছোট্ট ঘর। ভোর হলেই মা বেরিয়ে যান অন্যের বাড়িতে কাজ করতে। কখনও বাসন মাজা, কখনও কাপড় ধোয়া। সেই কষ্টের টাকাতেই চলে সংসার। সেই ঘরের মেয়েই প্রথম কুস্তির ম্যাটে দাঁড়ায়। তার পড়াশোনার খরচ, খেলাধুলার সরঞ্জাম, প্রতিদিনের ভাত— সবই এসেছে মায়ের ঘাম ঝরানো হাতে।

এত খেলা থাকতে কেন কুস্তিকে বেছে নিলেন? প্রশ্নটা করতেই জেমির উত্তর, ‘তখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম। আমাদের এলাকার নাসরিন আপু বাসার সামনের খালি মাঠে প্র্যাকটিস করাতেন। একদিন বাসায় এসে আম্মু বলে তুই কী প্র্যাকটিস করবি? এরপর রাজশাহী স্টেডিয়ামে গিয়ে কুস্তি খেলা দেখি। তখন থেকে ভালো লেগে যায়।’

মায়ের চেষ্টাতেই এতদূর এসেছেন জেমি

২০২২ সালে আনসারের হয়ে প্রথম জাতীয় প্রতিযোগিতায় রুপা জেতেন জেমি আক্তার। সেবারই প্রথম ঢাকায় আসেন। এর আগে রাজশাহীতে ১৫ দিনের ক্যাম্প করেন। পরের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে জাতীয় যুব গেমসেও জেতেন রুপা।

জেমির পারফরম্যান্স নজর কাড়ে জাতীয় দলের কোচ শারমিন সুলতানা শিরিনের। এরপর তাকে দলের সঙ্গে ভারতের বিশেষ অনুশীলন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের জন্য জাতীয় দলের ক্যাম্পে আছেন এই খেলোয়াড়।

ক্যারিয়ারে প্রথমবার সোনা জিতে রোমাঞ্চিত জেমি, ‘এর আগে তারুণ্যের উৎসবে সোনা জিতেছি। সেটা ছিল আন্তঃজেলায়। তাই তখন অত আনন্দ হয়নি। কিন্তু এবার আনসার, পুলিশের সিনিয়র খেলোয়াড়দের হারিয়েছি। সে কারণে বেশি ভালো লাগছে।’

এবারের সোনার পদক আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভালো খেলার আত্মবিশ্বাস যোগাচ্ছে তাকে। বলে, ‘আমি এখানে খেলতে এসে মোটেও ভয় পাইনি। বরং সাহস বেড়েছে, আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। প্রথম যখন আনসারের খেলোয়াড়কে হারিয়েছি তখন মনে হচ্ছিল পুলিশের খেলোয়াড়কেও হারাতে পারবো। আমার খেলা দেখে কোচ বলেছিলেন, তোকে দিয়ে হবে।’

পদকমঞ্চে উঠে সব কৃতিত্ব দিলেন মাকে, ‘আম্মু আমার জন্য অনেক কষ্ট করে। আমি নানির কাছে বড় হয়েছি। নানিও প্রচুর ভালো বাসে। তারা না খেয়ে থেকেছেন অনেক দিন। কিন্তু আমাকে না খাইয়ে রাখেননি। আমার খেলার সরঞ্জাম, যাতায়াত ভাড়াসহ সব টাকা-পয়সা যোগাড় করেছেন। নানি বলেন, এভাবেই তুই একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবি। আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। আমি মায়ের দুঃখ ঘোচাতে চাই।’

কুস্তি খেলায় আসার শুরুটা সহজ ছিল না জেমি আক্তারের। ছেলেদের খেলার মাঠে মেয়ের নাম শোনার পর সমাজে অনেক কথা উঠেছিল-মেয়ে হয়ে আবার কুস্তি?’— এমন প্রশ্ন বারবার শুনতে হয়েছে। কিন্তু দমে যাননি জেমি। কোচের পরামর্শ আর মায়ের অদম্য সাহসে এগিয়ে গেছেন। স্কুল শেষে অনুশীলন, রাতে পড়াশোনা, আবার ভোরে উঠে অনুশীলন। এটাই তার প্রতিদিনের রুটিন।

জাতীয় সার্ভিসেস কুস্তি প্রতিযোগিতায় যখন রেফারি জেমির হাত উঁচু করে ফলাফল ঘোষণা করেন, তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন জেমি। মেয়ে গলায় সোনার পদক ঝোলালেও, আসল জয় যেন মায়েরই!

ট্যাগঃ

অন্যের বাড়িতে কাজ করেন মা, মেয়ে জিতলেন সোনা

সময়ঃ ১২:১৭:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পল্টন হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের অস্থায়ী কুস্তি ম্যাটে একে একে আনসারের রোজিনা আক্তার ও পুলিশের সুবর্ণাকে কুস্তির প্যাঁচে ধরাশায়ী করলেন রাজশাহীর জেমি আক্তার। ততক্ষণে সোনার পদকও নিশ্চিত হয়ে গেছে তার।

তারুণ্যের উৎসব উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ কুস্তি ফেডারেশন আয়োজিত দুই দিনব্যাপী ‘ভিসতা ১৩তম জাতীয় সার্ভিসেস কুস্তি’ শেষ হয়েছে সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর)। এতে মহিলা বিভাগের ৭৬ কেজি ওজন শ্রেণিতে সোনা জিতেছেন জেমি।

বাবার চেহারা কেমন সেটা মনে নেই জেমির। থাকবে কী করে? জেমির জন্মের আগেই যে মারা যান! মা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন অন্যের বাড়িতে।

রাজশাহীর সেই সাধারণ গৃহপরিচারিকার ঘামে ভেজা দিনগুলো কুস্তির মঞ্চে জন্ম দিয়েছে এক অসাধারণ স্বপ্নের। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালানো সেই মায়ের মেয়ে জাতীয় সার্ভিসেস কুস্তি প্রতিযোগিতায় জিতে নিয়েছেন সোনার পদক। মায়ের সংগ্রাম আর মেয়ের দৃঢ়তায় লেখা এই গল্প শুধু কুস্তির মঞ্চেই নয়, হৃদয়ের মঞ্চেও এক অনন্য জয়গাথা।

রাজশাহীর অচেনা এক গলিপথের ছোট্ট ঘর। ভোর হলেই মা বেরিয়ে যান অন্যের বাড়িতে কাজ করতে। কখনও বাসন মাজা, কখনও কাপড় ধোয়া। সেই কষ্টের টাকাতেই চলে সংসার। সেই ঘরের মেয়েই প্রথম কুস্তির ম্যাটে দাঁড়ায়। তার পড়াশোনার খরচ, খেলাধুলার সরঞ্জাম, প্রতিদিনের ভাত— সবই এসেছে মায়ের ঘাম ঝরানো হাতে।

এত খেলা থাকতে কেন কুস্তিকে বেছে নিলেন? প্রশ্নটা করতেই জেমির উত্তর, ‘তখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম। আমাদের এলাকার নাসরিন আপু বাসার সামনের খালি মাঠে প্র্যাকটিস করাতেন। একদিন বাসায় এসে আম্মু বলে তুই কী প্র্যাকটিস করবি? এরপর রাজশাহী স্টেডিয়ামে গিয়ে কুস্তি খেলা দেখি। তখন থেকে ভালো লেগে যায়।’

মায়ের চেষ্টাতেই এতদূর এসেছেন জেমি

২০২২ সালে আনসারের হয়ে প্রথম জাতীয় প্রতিযোগিতায় রুপা জেতেন জেমি আক্তার। সেবারই প্রথম ঢাকায় আসেন। এর আগে রাজশাহীতে ১৫ দিনের ক্যাম্প করেন। পরের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে জাতীয় যুব গেমসেও জেতেন রুপা।

জেমির পারফরম্যান্স নজর কাড়ে জাতীয় দলের কোচ শারমিন সুলতানা শিরিনের। এরপর তাকে দলের সঙ্গে ভারতের বিশেষ অনুশীলন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের জন্য জাতীয় দলের ক্যাম্পে আছেন এই খেলোয়াড়।

ক্যারিয়ারে প্রথমবার সোনা জিতে রোমাঞ্চিত জেমি, ‘এর আগে তারুণ্যের উৎসবে সোনা জিতেছি। সেটা ছিল আন্তঃজেলায়। তাই তখন অত আনন্দ হয়নি। কিন্তু এবার আনসার, পুলিশের সিনিয়র খেলোয়াড়দের হারিয়েছি। সে কারণে বেশি ভালো লাগছে।’

এবারের সোনার পদক আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভালো খেলার আত্মবিশ্বাস যোগাচ্ছে তাকে। বলে, ‘আমি এখানে খেলতে এসে মোটেও ভয় পাইনি। বরং সাহস বেড়েছে, আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। প্রথম যখন আনসারের খেলোয়াড়কে হারিয়েছি তখন মনে হচ্ছিল পুলিশের খেলোয়াড়কেও হারাতে পারবো। আমার খেলা দেখে কোচ বলেছিলেন, তোকে দিয়ে হবে।’

পদকমঞ্চে উঠে সব কৃতিত্ব দিলেন মাকে, ‘আম্মু আমার জন্য অনেক কষ্ট করে। আমি নানির কাছে বড় হয়েছি। নানিও প্রচুর ভালো বাসে। তারা না খেয়ে থেকেছেন অনেক দিন। কিন্তু আমাকে না খাইয়ে রাখেননি। আমার খেলার সরঞ্জাম, যাতায়াত ভাড়াসহ সব টাকা-পয়সা যোগাড় করেছেন। নানি বলেন, এভাবেই তুই একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবি। আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। আমি মায়ের দুঃখ ঘোচাতে চাই।’

কুস্তি খেলায় আসার শুরুটা সহজ ছিল না জেমি আক্তারের। ছেলেদের খেলার মাঠে মেয়ের নাম শোনার পর সমাজে অনেক কথা উঠেছিল-মেয়ে হয়ে আবার কুস্তি?’— এমন প্রশ্ন বারবার শুনতে হয়েছে। কিন্তু দমে যাননি জেমি। কোচের পরামর্শ আর মায়ের অদম্য সাহসে এগিয়ে গেছেন। স্কুল শেষে অনুশীলন, রাতে পড়াশোনা, আবার ভোরে উঠে অনুশীলন। এটাই তার প্রতিদিনের রুটিন।

জাতীয় সার্ভিসেস কুস্তি প্রতিযোগিতায় যখন রেফারি জেমির হাত উঁচু করে ফলাফল ঘোষণা করেন, তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন জেমি। মেয়ে গলায় সোনার পদক ঝোলালেও, আসল জয় যেন মায়েরই!