আবুল আবদ বুঝলেন, এটা এক বস্তা, দুই বস্তা বা দশ বস্তা চুরির মতো নয়, তার চেয়েও জটিল। এই লোকটার সঙ্গে লেনদেনের চিন্তায় তাঁর মনে ঘৃণার একটা আঠালো অনুভূতি জন্ম নিল। শিবিরের সবাই একে বলে রক্তচোষা। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর মনে হলো, যদি একদিন তিনি তাঁবুতে ফিরতে পারেন আবদুর রহমানের জন্য নতুন জামা আর তাঁর স্ত্রীর জন্য টুকটাক কিছু জিনিস নিয়ে, এই দীর্ঘ বঞ্চনার পর, তাদের হাসি কত সুন্দর হবে! শুধু আবদুর রহমানের হাসিই এই ঝুঁকি নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যদি তিনি ব্যর্থ হন? তাঁর স্ত্রী আর ছেলের জন্য কী করুণ নিয়তি অপেক্ষা করছে? তখন আবদুর রহমান জুতা পালিশের বাক্স কাঁধে নিয়ে রাস্তায় বসে থাকবে, তার ছোট্ট মাথাটা নিচু হয়ে থাকবে চকচকে জুতাগুলোর ওপর। কী ভয়ংকর নিয়তি! আর যদি তিনি সফল হন? তাহলে আবদুর রহমান হবে নতুন মানুষ। স্ত্রীর চোখ থেকে সেই ভয়ানক প্রশ্ন মুছে যাবে। সফল হলে, প্রতি বৃষ্টির রাতে এই খানা খোঁড়ার ট্র্যাজেডি আর ভোগ করতে হবে না। তিনি এমন জীবন যাপন করবেন, যা এখন কল্পনাও করতে পারছেন না।
‘কেন এই অভিশপ্ত খানা ছেড়ে দিচ্ছ না? চলো, সূর্য ওঠার আগেই শুরু করি।’
হ্যাঁ, কেন ছেড়ে দেবেন না? আবদুর রহমান তাঁবুর কোণে ঠান্ডায় কাঁপছে। তার শ্বাস যেন আবুল আবদের ঠান্ডা কপালে এসে লাগছে। তিনি খুব করে চান, আবদুর রহমানকে সব দুর্বলতা আর ভয় থেকে মুক্ত করতে।
বৃষ্টি প্রায় থেমে গেছে। আকাশে চাঁদ একটা রুক্ষ পথ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে।
আবু সামির এখনো সামনে দাঁড়িয়ে, যেন কালো ছায়ার দানব। বড় বড় পা দুটি কাদায় গাঁথা। পুরোনো কোটের কলার কানের ওপরে তুলে দেওয়া। এখনো জবাবের অপেক্ষা করছে। এই মানুষটা, যে তার সামনে দাঁড়িয়ে, সঙ্গে করে একটা নতুন, রহস্যময় ভাগ্য নিয়ে এসেছে। তাঁকে প্রলুব্ধ করছে গুদাম থেকে বস্তা তুলে কোথাও নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রতি মাসে সেই মার্কিন আসে, ময়দার স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে তার পরিষ্কার হাত দুটো ঘষে, নীল চোখে হাসে, যেন একটা বিড়াল ইঁদুরের গর্তের সামনে তৈরি হয়ে বসে আছে।
‘কত দিন ধরে তুমি এই পাহারাদার আর কর্মীর সঙ্গে কাজ করছ?’
‘তুমি কি আমার তদন্ত করতে চাও, নাকি ময়দার দামের মধ্যে কতটা তুমি নেবে আর কতখানি ওই শয়তানগুলোকে দিতে হয়, সেটা বুঝতে চাইছ? শোনো, এই মার্কিন আমার বন্ধু। সে গোছানো কাজ পছন্দ করে। সে আমাকে সব সময় সময়ের গুরুত্ব দিতে বলে। দেরি করা পছন্দ করে না। আমাদের এখনই শুরু করতে হবে। তাড়াতাড়ি।’