১০:৪৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সত্য ফেরারি : বেকন থেকে হারারি

  • Voice24 Admin
  • Update Time : ০৬:৩৪:২৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
  • ৫৪৮ Time View

“সত্য ফেরারি” কবিতায় কবি সত্যকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না। চিনির বয়াম থেকে বাজারের ব্যাগ, সিগারেটের কেস কিংবা পানের ডিব্বায়—সত্য নেই। হতাশা, প্রেম কিংবা ভালবাসায়ও তার ঠিকুজি মিলছে না। তাহলে কোথায় পালিয়েছেন সত্যবাবু? প্রশ্নটি শুধু কবির নয়, আমাদের সকলের। এই উত্তর-আধুনিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির অতিপ্রাচুর্যে প্রতিনিয়ত উৎপাদিত ‘সত্য’ যেন দার্শনিক জঁ বোদ্রিয়ারের ভাষায় “মূর্ত বাস্তব নয়, বাস্তবের প্রতিস্থাপন।” বেকনের প্রয়োগবাদী অনুসন্ধান সত্যকে প্রমাণ-নির্ভর করে তুলে, অথচ জিজেকের লাকানিয়ান দর্শন বলছে, সত্য সবসময় এক কাঙ্ক্ষিত ঘাটতি—পুরোপুরি ধরা পড়ে না। সাম্প্রতিক কালে ঐতিহাসিক নোয়া হারারি এরমধ্যে যুক্ত করেন বিবর্তনমূলক সমাজতত্ত্ব, যেখানে ‘সত্য’ এক কার্যকর কল্পনা—ধর্ম, জাতি কিংবা অর্থনীতির মতোই সমাজে টিকে থাকার কৌশল। কোটি কোটি তথ্যের কোরিওগ্রাফির মধ্যে সত্য এখন পালিয়ে বেড়ানো ‘ফেরারি’— চতুর জার্নালিস্ট, মঞ্চ কাঁপানো রাজনৈতিক, মেহফিল গরম করা ধর্মবেত্তা, কূটতার্কিক দার্শনিক, বাকপটু প্রেমিক কিংবা আদার ব্যাপারি—সকলেই হাতে হারিকেন নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে।

১৭শ শতকের শুরুর দিকে ফ্রান্সিস বেকন লিখেছিলেন যে, সত্য নৈতিক আর ঈশ্বরমুখী এক অনুসন্ধান। “Of Truth” প্রবন্ধে রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পিলাট জিসাস ক্রাইস্টকে জিজ্ঞেস করছেন, “সত্য কী?” কিন্তু সে উত্তর না শুনেই গভর্নর সরে যায়। বেকন মনে করেন, এই প্রশ্নটি আমাদের সত্য থেকে এড়িয়ে চলার প্রবণতার প্রতীক। সত্য শুধু তথ্যগত সঠিকতা নয়—এটি এক ধরনের নৈতিক স্পষ্টতা। তিনি একে বলেন “মানব প্রকৃতির সর্বোচ্চ কল্যাণ”। তিনি সত্যের আলোকিত গুণের সঙ্গে মিথ্যার কোমল কিন্তু বিভ্রান্তিকর আলোকে তুলনা করেন। সত্য অনেকটা দিনের আলো—যা সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখায়; আর মিথ্যা হলো মোমবাতির আলো—যা দেখতে সুন্দর, কিন্তু গোপন করে রাখে অনেক কিছু। বেকনের মতে, সত্যের সাথে কিছুটা মিথ্যা বা অলীক বিষয় মেশা থাকলে বিষয়টি স্থায়িত্ব বাড়ে। যেমন খাঁটি স্বর্ণ দিয়ে গহনা হয় না, কিছুটা মিথ্যার খাদ থাকলে তা টেকসই হয়। সত্যের জন্য যতই শহীদ হওয়ার ভান করি না কেন, আমরা আসলে মিথ্যার দিকে ঝুঁকি, কারণ মিথ্যাই আরামদায়ক, দৃষ্টিনন্দন, এবং কল্পনায় ঋদ্ধ।

উত্তর আধুনিক দার্শনিক জঁ বোদ্রিয়ারের বয়ানে, বাস্তব আর তার প্রতিরূপ—দুয়ের মধ্যে সীমারেখা মুছে গেছে। তিনি বলেন, “The simulacrum is never that which conceals the truth—it is the truth which conceals that there is none.” আজকের সমাজ ‘সিমুলাক্রম’-এর ভিতরে বাস করে, যেখানে ইমেজ, প্রতিকৃতি ও কল্পনার মিশেলে সত্য, অনুকরণের অনুকরণ। আমরা যে ‘সত্য’ খুঁজছি, তা হতে পারে নিছক একটি সামাজিক নির্মাণ—যা বারবার পুনরুৎপাদিত হয়, অথচ চূড়ান্ত বাস্তবতার ছোঁয়া নেই। বোদ্রিয়ারের বয়ানে:“মানচিত্র এখন ভূখণ্ডের চেয়ে বড় হয়ে গেছে।” অর্থাৎ, বাস্তবের প্রতিনিধিত্বকারী চিত্র, যেমন মিডিয়া, মিথ, বা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, বাস্তবতাকেই পিছিয়ে দিয়ে এক নতুন সত্য তৈরি করছে। সত্য এখন আর কোনো নির্ভরযোগ্য বাস্তবতার প্রতিফলন নয়, বরং চিহ্নের খেলা, মডেলের পুনরুৎপাদন, এবং মিডিয়ার নির্মাণ। মিডিয়ায় রং চং মাখানো ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ , বিজ্ঞাপনে সুখের প্রতিশ্রুতি, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের রঙিন ছবি—সবই এমন “সত্য” যা বাস্তবকে নয়, বরং তার অনুকরণকে তুলে ধরে। এখান থেকেই শুরু হয়েছে উত্তর-আধুনিক সময়ের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ কে ভেঙে ফেলার যাত্রা।

এদিকে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত চিন্তক জিজেক তাঁর ১৯৮৯ সালের গ্রন্থ The Sublime Object of Ideology-এ হেগেলিয়ান দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও লাকাঁর মনোবিশ্লেষণের সমন্বয়ে দেখান যে সত্য আদতে ভাবাদর্শগত কাঠামোর মাধ্যমে গঠিত ও বিকৃত হয়ে থাকে। জিজেকের মতে, সমস্যাটি শুধুমাত্র এই নয় যে আমরা মিথ্যা বলি—আমরা নিজেরাই আমাদের তৈরি বিভ্রমে বিশ্বাস করি, কারণ এগুলিই আমাদের বাস্তবতার কাঠামো তৈরি করে। লাকাঁর মনোবিশ্লেষণ থেকে ধারণা নিয়ে, জিজেক বলেন যে আদর্শবাদ বা ইডিওলজি আমাদেরকে সরাসরি প্রতারণা করে না; বরং এটি আমাদের অবচেতন আকাঙ্ক্ষাগুলিকে গঠন করে। তার মতে, মানুষ অজ্ঞতা বা দুর্নীতির কারণে (যেমন বেকন ভেবেছিলেন) ভুলের প্রতি অনুরাগী হয় না, বরং আদর্শবাদ এক রকমের কল্পনার জগৎ তৈরি করে যার মাধ্যমে জীবনের দ্বন্দ্বগুলো সহনীয় হয়ে ওঠে। তিনি “fetishistic disavowal”-এর ধারণা দেন—এক কথায় আত্মপ্রবঞ্চনা। এমন এক মনস্তাত্ত্বিক কৌশল, যেখানে মানুষ কোনো সত্যকে জানে, কিন্তু সেই সত্যকে মানতে চায় না—যেন সে সেই জ্ঞানের মোকাবিলা না করেই জীবনের সান্ত্বনা খুঁজে নেয়। আমরা জানি জলবায়ু পরিবর্তন বাস্তব, তবু মনে করি খুব তাড়াতাড়ি কিছু করতে হবে না। আমরা জানি ভোক্তাবাদী পুঁজিবাদ অসমতা তৈরি করে, তবুও কেনাকাটা চালিয়ে যাই। অনেকটা সত্য ও অসত্য, বাস্তবতা ও আপাতত সত্য—এইসব হাবিজাবি আপাত পরস্পরবিরোধী সত্য-অসত্য নিয়েই আমাদের চলতে হয়। অনেকটা ঘর-গেরস্থালির জোড়াতালি অস্তিত্বের মতো।

জিজেকের সত্য কোনো ঈশ্বরীয় দিশারী নয়—বরং এটি কল্পিত আদর্শিক দুনিয়াকে চূর্ণ করা একধরনের মানসিক ধাক্কা বা বিপর্যয়। যেখানে বেকনের কাছে সত্য মানে একধরনের আত্মিক অনুশাসন যা মানুষকে উন্নত করে, সেখানে জিজেকের চোখে সত্য মানে এক নির্মম পর্দা ছিঁড়ে ফেলা, একটা আরামদায়ক মুখোশ হঠাৎ টেনে খুলে ফেলা—যা আমাদের বিশ্বাসের আরামদায়ক ঘেরাটোপের নিচে লুকিয়ে থাকা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে তুলে। সত্য মুক্তি দেয় না; বরং এটি গোটা মানসিক কাঠামোকে অস্থির ও টালমাটাল করে তুলে। সত্য কোনো নির্বাণ প্রাপ্তি নয়, নয় কোনো প্রশান্তির উৎস; বরং প্রচন্ড অভ্যন্তরীণ ক্ষরণ ও বিস্ফোরণ।

এবার আসি ইউভাল নোয়া হারারির কথায়—Sapiens এ হারারি জোর দিয়ে বলেন, মানুষ প্রজাতি হিসেবে পৃথিবীতে যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তা শারীরিক শক্তি বা বুদ্ধির জন্য নয়, বরং কারণ তারা একসঙ্গে কল্পিত কাহিনিগুলিতে বিশ্বাস রাখতে পারে—যেমন ধর্ম, জাতি বা কর্পোরেশন। হারারির দৃষ্টিতে, সত্য হচ্ছে একধরনের “জ্ঞানগত প্রযুক্তি”—জুতসই কাজে লাগার মতো একটা প্রযুক্তি। যদি সমাজে শৃঙ্খলা, সামঞ্জস্য ও বৃহৎ পরিসরে সহযোগিতা বজায় রাখতে পারে, তাহলে তা কার্যকর। সত্যের মূল্য নির্ধারিত হয় এতে যে এটি আসলেই বাস্তব কিনা, তা দিয়ে নয়—বরং সেটি কতজন মানুষ একসাথে মানে, তার উপর ভিত্তি করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সত্য আর নৈতিক (যেমন বেকন ভাবতেন) নয়, বা মনস্তাত্ত্বিক (যেমন জিজেক বলতেন) নয়—বরং এটি একটি উপযোগী হাতিয়ার। যদি কাজে লাগে তো চলল, নাহলে বিদেয় হও বাবা। হারারি বলেন, আমরা আসলে সর্বদাই একধরনের “উত্তর-সত্য”(Post-truth) অবস্থাতেই বাস করে এসেছি; শুধু আজকের পার্থক্য হলো, মিথ্যা বা ফিকশন থাকা নয়, বরং সেই একসঙ্গে মানা ফিকশনগুলোর ভেঙে পড়া—বিশেষ করে ডিজিটাল যুগে। এই পৃথিবী নামক গ্রহে মানবপ্রজাতি আধিপত্য বিস্তার করেছে এই কারণে নয় যে তারা সত্যকে জয় করেছে, বরং এই কারণে যে তারা সমন্বিতভাবে একটি সামষ্টিক ফিকশনে বাস করছে। এই বিশ্লেষণের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। যদি আধুনিক সমাজগুলোর ভিত্তি গড়ে ওঠে এমন সব কল্পিত কাহিনির ওপর, তাহলে প্রশ্ন ওঠে—যখন এই গল্পগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায় (যেমন এখন হচ্ছে), তখন কী ঘটে? হারারি সতর্ক করেন যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ব্যক্তিগতকৃত অ্যালগোরিদম আর বিভক্ত “ইকো চেম্বার” আমাদের এমন এক পৃথিবীতে নিয়ে গেছে, যেখানে একটি সংহত বা সমন্বিত সত্য ধারণার লেশ মাত্র নেই। মানুষ মিথ্যা বিশ্বাস করছে সত্যের বদলে, এটা কোনো বড় ইস্যু নয় আর—বরং তারা বসবাস করছে বিভিন্ন বাস্তবতার মধ্যে, যেগুলো প্রত্যেকটাই নিজস্বভাবে পরিপূর্ণ ও চূড়ান্তভাবে বিশ্বাসযোগ্য। বর্তমান সময়ে উত্তর-সত্য (Post-truth) শব্দটি আবারও আলোচনায় এসেছে। মানুষ আজ আর তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে সত্য অনুসন্ধান করে না; বরং আবেগ, ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও মতামতের উপর অধিক নির্ভর করে। এ প্রবণতাই “Post-truth” বাস্তবতার প্রকাশ। অতি সম্প্রতি, ২০১৬ সালে, “Post-truth” শব্দটি অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সে বছরের “Word of the Year” হিসেবে স্বীকৃতি পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় বলেছিলেন: “কবি তব মনোভূমি রামের জন্মভূমি অযোধ্যার চেয়েও সত্য।” অর্থাৎ, মানুষ যা বিশ্বাস করে, মনের ভিতরে যেটা সত্য বলে মেনে নেয়, সেটাই তার কাছে চূড়ান্ত বাস্তবতা—বাস্তব সত্য যেটাই হোক না কেন।

ফ্রান্সিস বেকন, জঁ বোদ্রিয়ার, স্লাভয় জিজেক এবং ইউভাল নোয়া হারারির চিন্তাধারা এক করলে আমরা আমাদের বর্তমান সময়ের সংকটকে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারি। Post–Truth যুগে সত্য শুধুমাত্র বিপন্ন নয়; তা এখন নতুনভাবে গঠিত, রূপান্তরিত ও বিতরণ হচ্ছে—প্রযুক্তি, মনস্তত্ত্ব এবং রাজনীতির নতুন যুক্তির মাধ্যমে। তিনজনই বিশ্বাস করেন, সত্য আদতে আকাঙ্ক্ষা, ভাষা, ক্ষমতা এবং অন্বেষা। যদি শুরুতেই জানি এ বিষয়ে কোনো শক্ত অবস্থানে পৌঁছানো নিতান্তই অসত্য ব্যাপার সত্য নিয়ে এতক্ষণ কচকচানি করে লাভ কি হলো? সহজ উত্তর হলো, একটি লিবারেল ডিসকোর্স বা উদার বয়ানে পৌঁছানোর পূর্ব শর্ত সত্য নিয়ে এই আলাপটা জানা থাকা। যে দৃষ্টিকোণে দেখা যাক না কেন চূড়ান্ত দৃষ্টিতে সত্য নিতান্তই ব্যক্তি, সময় ও কার্যকারণ সম্পর্কের এলগরিদমের বাইরে যেতে পারবে না। তাহলে গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জীবনবেদ” নিতান্তই পণ্ডশ্রম? হয়ত এই পথ চলার মধ্যেই, পথের দিশা রয়ে যায়।

তাহলে, উত্তর-আধুনিক এই সময়ে একজন চিন্তক, লেখক বা নাগরিকের করণীয় কী? সম্ভবত তা বেকনের মতো শুধু সত্যকে ঈশ্বরের আসনে বসানো নয়, জিজেকের মতো দূর থেকে কল্পনার উপহাস করা নয়, বা হারারির মতো সব কিছুই আপেক্ষিক ভেবে বসে থাকা নয়। বরং আজকের দিনে সত্যের কাজ হলো: সমালোচনামূলক পুনর্গঠন— দ্রুত কোন উত্তর খুঁজে নয়, বরং সঠিক করে প্রশ্ন করতে পারাটাই এখন সত্যান্বেষীদের প্রধান কাজ। হান্না আরেন্টের মতে, সত্যিকারের চিন্তা কখনোই নিষ্ক্রিয় নয়। চূড়ান্তভাবে “বিপজ্জনক চিন্তা বলে কিছু নেই; চিন্তাকেই বিপজ্জনক বলা যায়।” বিপজ্জনক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়াটাই সত্যের একক মালিকানা দাবিদারদের আঘাত করার সেরা উপায়। মিথ্যার পাইকারি আড়তদার ডোনাল্ড ট্রাম্পের সোশ্যাল মিডিয়ার নাম Truth। ব্যাপারটা বেশ মজার তাই না? সত্যের পাইকারি ইজারাদারদের জিজ্ঞেস করা উচিত “সত্য কি?” প্রশ্ন করার এই সৎ সাহসই হতে পারে আজকের সবচেয়ে বিপ্লবী কাজ। যতই প্যারাডক্সিক্যাল শোনাক, কোনো এক লিবারেল বয়ান নির্মাণের মাধ্যমেই শেষ পর্যন্ত আসাদ চৌধুরীর সেই “ফেরারি সত্যকে” খুঁজতে হবে।

ট্যাগঃ

সত্য ফেরারি : বেকন থেকে হারারি

Update Time : ০৬:৩৪:২৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

“সত্য ফেরারি” কবিতায় কবি সত্যকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না। চিনির বয়াম থেকে বাজারের ব্যাগ, সিগারেটের কেস কিংবা পানের ডিব্বায়—সত্য নেই। হতাশা, প্রেম কিংবা ভালবাসায়ও তার ঠিকুজি মিলছে না। তাহলে কোথায় পালিয়েছেন সত্যবাবু? প্রশ্নটি শুধু কবির নয়, আমাদের সকলের। এই উত্তর-আধুনিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির অতিপ্রাচুর্যে প্রতিনিয়ত উৎপাদিত ‘সত্য’ যেন দার্শনিক জঁ বোদ্রিয়ারের ভাষায় “মূর্ত বাস্তব নয়, বাস্তবের প্রতিস্থাপন।” বেকনের প্রয়োগবাদী অনুসন্ধান সত্যকে প্রমাণ-নির্ভর করে তুলে, অথচ জিজেকের লাকানিয়ান দর্শন বলছে, সত্য সবসময় এক কাঙ্ক্ষিত ঘাটতি—পুরোপুরি ধরা পড়ে না। সাম্প্রতিক কালে ঐতিহাসিক নোয়া হারারি এরমধ্যে যুক্ত করেন বিবর্তনমূলক সমাজতত্ত্ব, যেখানে ‘সত্য’ এক কার্যকর কল্পনা—ধর্ম, জাতি কিংবা অর্থনীতির মতোই সমাজে টিকে থাকার কৌশল। কোটি কোটি তথ্যের কোরিওগ্রাফির মধ্যে সত্য এখন পালিয়ে বেড়ানো ‘ফেরারি’— চতুর জার্নালিস্ট, মঞ্চ কাঁপানো রাজনৈতিক, মেহফিল গরম করা ধর্মবেত্তা, কূটতার্কিক দার্শনিক, বাকপটু প্রেমিক কিংবা আদার ব্যাপারি—সকলেই হাতে হারিকেন নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে।

১৭শ শতকের শুরুর দিকে ফ্রান্সিস বেকন লিখেছিলেন যে, সত্য নৈতিক আর ঈশ্বরমুখী এক অনুসন্ধান। “Of Truth” প্রবন্ধে রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পিলাট জিসাস ক্রাইস্টকে জিজ্ঞেস করছেন, “সত্য কী?” কিন্তু সে উত্তর না শুনেই গভর্নর সরে যায়। বেকন মনে করেন, এই প্রশ্নটি আমাদের সত্য থেকে এড়িয়ে চলার প্রবণতার প্রতীক। সত্য শুধু তথ্যগত সঠিকতা নয়—এটি এক ধরনের নৈতিক স্পষ্টতা। তিনি একে বলেন “মানব প্রকৃতির সর্বোচ্চ কল্যাণ”। তিনি সত্যের আলোকিত গুণের সঙ্গে মিথ্যার কোমল কিন্তু বিভ্রান্তিকর আলোকে তুলনা করেন। সত্য অনেকটা দিনের আলো—যা সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখায়; আর মিথ্যা হলো মোমবাতির আলো—যা দেখতে সুন্দর, কিন্তু গোপন করে রাখে অনেক কিছু। বেকনের মতে, সত্যের সাথে কিছুটা মিথ্যা বা অলীক বিষয় মেশা থাকলে বিষয়টি স্থায়িত্ব বাড়ে। যেমন খাঁটি স্বর্ণ দিয়ে গহনা হয় না, কিছুটা মিথ্যার খাদ থাকলে তা টেকসই হয়। সত্যের জন্য যতই শহীদ হওয়ার ভান করি না কেন, আমরা আসলে মিথ্যার দিকে ঝুঁকি, কারণ মিথ্যাই আরামদায়ক, দৃষ্টিনন্দন, এবং কল্পনায় ঋদ্ধ।

উত্তর আধুনিক দার্শনিক জঁ বোদ্রিয়ারের বয়ানে, বাস্তব আর তার প্রতিরূপ—দুয়ের মধ্যে সীমারেখা মুছে গেছে। তিনি বলেন, “The simulacrum is never that which conceals the truth—it is the truth which conceals that there is none.” আজকের সমাজ ‘সিমুলাক্রম’-এর ভিতরে বাস করে, যেখানে ইমেজ, প্রতিকৃতি ও কল্পনার মিশেলে সত্য, অনুকরণের অনুকরণ। আমরা যে ‘সত্য’ খুঁজছি, তা হতে পারে নিছক একটি সামাজিক নির্মাণ—যা বারবার পুনরুৎপাদিত হয়, অথচ চূড়ান্ত বাস্তবতার ছোঁয়া নেই। বোদ্রিয়ারের বয়ানে:“মানচিত্র এখন ভূখণ্ডের চেয়ে বড় হয়ে গেছে।” অর্থাৎ, বাস্তবের প্রতিনিধিত্বকারী চিত্র, যেমন মিডিয়া, মিথ, বা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, বাস্তবতাকেই পিছিয়ে দিয়ে এক নতুন সত্য তৈরি করছে। সত্য এখন আর কোনো নির্ভরযোগ্য বাস্তবতার প্রতিফলন নয়, বরং চিহ্নের খেলা, মডেলের পুনরুৎপাদন, এবং মিডিয়ার নির্মাণ। মিডিয়ায় রং চং মাখানো ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ , বিজ্ঞাপনে সুখের প্রতিশ্রুতি, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের রঙিন ছবি—সবই এমন “সত্য” যা বাস্তবকে নয়, বরং তার অনুকরণকে তুলে ধরে। এখান থেকেই শুরু হয়েছে উত্তর-আধুনিক সময়ের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ কে ভেঙে ফেলার যাত্রা।

এদিকে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত চিন্তক জিজেক তাঁর ১৯৮৯ সালের গ্রন্থ The Sublime Object of Ideology-এ হেগেলিয়ান দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও লাকাঁর মনোবিশ্লেষণের সমন্বয়ে দেখান যে সত্য আদতে ভাবাদর্শগত কাঠামোর মাধ্যমে গঠিত ও বিকৃত হয়ে থাকে। জিজেকের মতে, সমস্যাটি শুধুমাত্র এই নয় যে আমরা মিথ্যা বলি—আমরা নিজেরাই আমাদের তৈরি বিভ্রমে বিশ্বাস করি, কারণ এগুলিই আমাদের বাস্তবতার কাঠামো তৈরি করে। লাকাঁর মনোবিশ্লেষণ থেকে ধারণা নিয়ে, জিজেক বলেন যে আদর্শবাদ বা ইডিওলজি আমাদেরকে সরাসরি প্রতারণা করে না; বরং এটি আমাদের অবচেতন আকাঙ্ক্ষাগুলিকে গঠন করে। তার মতে, মানুষ অজ্ঞতা বা দুর্নীতির কারণে (যেমন বেকন ভেবেছিলেন) ভুলের প্রতি অনুরাগী হয় না, বরং আদর্শবাদ এক রকমের কল্পনার জগৎ তৈরি করে যার মাধ্যমে জীবনের দ্বন্দ্বগুলো সহনীয় হয়ে ওঠে। তিনি “fetishistic disavowal”-এর ধারণা দেন—এক কথায় আত্মপ্রবঞ্চনা। এমন এক মনস্তাত্ত্বিক কৌশল, যেখানে মানুষ কোনো সত্যকে জানে, কিন্তু সেই সত্যকে মানতে চায় না—যেন সে সেই জ্ঞানের মোকাবিলা না করেই জীবনের সান্ত্বনা খুঁজে নেয়। আমরা জানি জলবায়ু পরিবর্তন বাস্তব, তবু মনে করি খুব তাড়াতাড়ি কিছু করতে হবে না। আমরা জানি ভোক্তাবাদী পুঁজিবাদ অসমতা তৈরি করে, তবুও কেনাকাটা চালিয়ে যাই। অনেকটা সত্য ও অসত্য, বাস্তবতা ও আপাতত সত্য—এইসব হাবিজাবি আপাত পরস্পরবিরোধী সত্য-অসত্য নিয়েই আমাদের চলতে হয়। অনেকটা ঘর-গেরস্থালির জোড়াতালি অস্তিত্বের মতো।

জিজেকের সত্য কোনো ঈশ্বরীয় দিশারী নয়—বরং এটি কল্পিত আদর্শিক দুনিয়াকে চূর্ণ করা একধরনের মানসিক ধাক্কা বা বিপর্যয়। যেখানে বেকনের কাছে সত্য মানে একধরনের আত্মিক অনুশাসন যা মানুষকে উন্নত করে, সেখানে জিজেকের চোখে সত্য মানে এক নির্মম পর্দা ছিঁড়ে ফেলা, একটা আরামদায়ক মুখোশ হঠাৎ টেনে খুলে ফেলা—যা আমাদের বিশ্বাসের আরামদায়ক ঘেরাটোপের নিচে লুকিয়ে থাকা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে তুলে। সত্য মুক্তি দেয় না; বরং এটি গোটা মানসিক কাঠামোকে অস্থির ও টালমাটাল করে তুলে। সত্য কোনো নির্বাণ প্রাপ্তি নয়, নয় কোনো প্রশান্তির উৎস; বরং প্রচন্ড অভ্যন্তরীণ ক্ষরণ ও বিস্ফোরণ।

এবার আসি ইউভাল নোয়া হারারির কথায়—Sapiens এ হারারি জোর দিয়ে বলেন, মানুষ প্রজাতি হিসেবে পৃথিবীতে যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তা শারীরিক শক্তি বা বুদ্ধির জন্য নয়, বরং কারণ তারা একসঙ্গে কল্পিত কাহিনিগুলিতে বিশ্বাস রাখতে পারে—যেমন ধর্ম, জাতি বা কর্পোরেশন। হারারির দৃষ্টিতে, সত্য হচ্ছে একধরনের “জ্ঞানগত প্রযুক্তি”—জুতসই কাজে লাগার মতো একটা প্রযুক্তি। যদি সমাজে শৃঙ্খলা, সামঞ্জস্য ও বৃহৎ পরিসরে সহযোগিতা বজায় রাখতে পারে, তাহলে তা কার্যকর। সত্যের মূল্য নির্ধারিত হয় এতে যে এটি আসলেই বাস্তব কিনা, তা দিয়ে নয়—বরং সেটি কতজন মানুষ একসাথে মানে, তার উপর ভিত্তি করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সত্য আর নৈতিক (যেমন বেকন ভাবতেন) নয়, বা মনস্তাত্ত্বিক (যেমন জিজেক বলতেন) নয়—বরং এটি একটি উপযোগী হাতিয়ার। যদি কাজে লাগে তো চলল, নাহলে বিদেয় হও বাবা। হারারি বলেন, আমরা আসলে সর্বদাই একধরনের “উত্তর-সত্য”(Post-truth) অবস্থাতেই বাস করে এসেছি; শুধু আজকের পার্থক্য হলো, মিথ্যা বা ফিকশন থাকা নয়, বরং সেই একসঙ্গে মানা ফিকশনগুলোর ভেঙে পড়া—বিশেষ করে ডিজিটাল যুগে। এই পৃথিবী নামক গ্রহে মানবপ্রজাতি আধিপত্য বিস্তার করেছে এই কারণে নয় যে তারা সত্যকে জয় করেছে, বরং এই কারণে যে তারা সমন্বিতভাবে একটি সামষ্টিক ফিকশনে বাস করছে। এই বিশ্লেষণের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। যদি আধুনিক সমাজগুলোর ভিত্তি গড়ে ওঠে এমন সব কল্পিত কাহিনির ওপর, তাহলে প্রশ্ন ওঠে—যখন এই গল্পগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায় (যেমন এখন হচ্ছে), তখন কী ঘটে? হারারি সতর্ক করেন যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ব্যক্তিগতকৃত অ্যালগোরিদম আর বিভক্ত “ইকো চেম্বার” আমাদের এমন এক পৃথিবীতে নিয়ে গেছে, যেখানে একটি সংহত বা সমন্বিত সত্য ধারণার লেশ মাত্র নেই। মানুষ মিথ্যা বিশ্বাস করছে সত্যের বদলে, এটা কোনো বড় ইস্যু নয় আর—বরং তারা বসবাস করছে বিভিন্ন বাস্তবতার মধ্যে, যেগুলো প্রত্যেকটাই নিজস্বভাবে পরিপূর্ণ ও চূড়ান্তভাবে বিশ্বাসযোগ্য। বর্তমান সময়ে উত্তর-সত্য (Post-truth) শব্দটি আবারও আলোচনায় এসেছে। মানুষ আজ আর তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে সত্য অনুসন্ধান করে না; বরং আবেগ, ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও মতামতের উপর অধিক নির্ভর করে। এ প্রবণতাই “Post-truth” বাস্তবতার প্রকাশ। অতি সম্প্রতি, ২০১৬ সালে, “Post-truth” শব্দটি অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সে বছরের “Word of the Year” হিসেবে স্বীকৃতি পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় বলেছিলেন: “কবি তব মনোভূমি রামের জন্মভূমি অযোধ্যার চেয়েও সত্য।” অর্থাৎ, মানুষ যা বিশ্বাস করে, মনের ভিতরে যেটা সত্য বলে মেনে নেয়, সেটাই তার কাছে চূড়ান্ত বাস্তবতা—বাস্তব সত্য যেটাই হোক না কেন।

ফ্রান্সিস বেকন, জঁ বোদ্রিয়ার, স্লাভয় জিজেক এবং ইউভাল নোয়া হারারির চিন্তাধারা এক করলে আমরা আমাদের বর্তমান সময়ের সংকটকে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারি। Post–Truth যুগে সত্য শুধুমাত্র বিপন্ন নয়; তা এখন নতুনভাবে গঠিত, রূপান্তরিত ও বিতরণ হচ্ছে—প্রযুক্তি, মনস্তত্ত্ব এবং রাজনীতির নতুন যুক্তির মাধ্যমে। তিনজনই বিশ্বাস করেন, সত্য আদতে আকাঙ্ক্ষা, ভাষা, ক্ষমতা এবং অন্বেষা। যদি শুরুতেই জানি এ বিষয়ে কোনো শক্ত অবস্থানে পৌঁছানো নিতান্তই অসত্য ব্যাপার সত্য নিয়ে এতক্ষণ কচকচানি করে লাভ কি হলো? সহজ উত্তর হলো, একটি লিবারেল ডিসকোর্স বা উদার বয়ানে পৌঁছানোর পূর্ব শর্ত সত্য নিয়ে এই আলাপটা জানা থাকা। যে দৃষ্টিকোণে দেখা যাক না কেন চূড়ান্ত দৃষ্টিতে সত্য নিতান্তই ব্যক্তি, সময় ও কার্যকারণ সম্পর্কের এলগরিদমের বাইরে যেতে পারবে না। তাহলে গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জীবনবেদ” নিতান্তই পণ্ডশ্রম? হয়ত এই পথ চলার মধ্যেই, পথের দিশা রয়ে যায়।

তাহলে, উত্তর-আধুনিক এই সময়ে একজন চিন্তক, লেখক বা নাগরিকের করণীয় কী? সম্ভবত তা বেকনের মতো শুধু সত্যকে ঈশ্বরের আসনে বসানো নয়, জিজেকের মতো দূর থেকে কল্পনার উপহাস করা নয়, বা হারারির মতো সব কিছুই আপেক্ষিক ভেবে বসে থাকা নয়। বরং আজকের দিনে সত্যের কাজ হলো: সমালোচনামূলক পুনর্গঠন— দ্রুত কোন উত্তর খুঁজে নয়, বরং সঠিক করে প্রশ্ন করতে পারাটাই এখন সত্যান্বেষীদের প্রধান কাজ। হান্না আরেন্টের মতে, সত্যিকারের চিন্তা কখনোই নিষ্ক্রিয় নয়। চূড়ান্তভাবে “বিপজ্জনক চিন্তা বলে কিছু নেই; চিন্তাকেই বিপজ্জনক বলা যায়।” বিপজ্জনক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়াটাই সত্যের একক মালিকানা দাবিদারদের আঘাত করার সেরা উপায়। মিথ্যার পাইকারি আড়তদার ডোনাল্ড ট্রাম্পের সোশ্যাল মিডিয়ার নাম Truth। ব্যাপারটা বেশ মজার তাই না? সত্যের পাইকারি ইজারাদারদের জিজ্ঞেস করা উচিত “সত্য কি?” প্রশ্ন করার এই সৎ সাহসই হতে পারে আজকের সবচেয়ে বিপ্লবী কাজ। যতই প্যারাডক্সিক্যাল শোনাক, কোনো এক লিবারেল বয়ান নির্মাণের মাধ্যমেই শেষ পর্যন্ত আসাদ চৌধুরীর সেই “ফেরারি সত্যকে” খুঁজতে হবে।