২০২৪ সালের ৯ জুলাই, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের নিযুক্ত অন্তত ১১ জন বিশেষজ্ঞ গাজায় দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি জরুরি সতর্কবার্তা (মেডে কল) জারি করেন।
তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা ঘোষণা করছি যে, ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ইচ্ছাকৃত ও লক্ষ্যভিত্তিক ক্ষুধা জ্বালিয়ে রাখা একটি গণহত্যামূলক সহিংসতার রূপ এবং এর ফলে গাজাজুড়ে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাই, যেকোনোভাবে সড়কপথে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে, ইসরায়েলের অবরোধ শেষ করতে এবং একটি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করতে।”
এই বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন মাইকেল ফাখরি, যিনি খাদ্যাধিকারের বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদনকারী (র্যাপোরটিয়ার); পেদ্রো অ্যারোহো-আগুদো, যিনি নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন-সংক্রান্ত মানবাধিকার বিষয়ের বিশেষ প্রতিবেদনকারী এবং ফ্রানচেসকা আলবানিজে, যিনি ১৯৬৭ সাল থেকে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদনকারী। তাদের মতে, মধ্য গাজায় চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও শিশুদের না খেয়ে মৃত্যুবরণ করা এমন একটি বাস্তবতা, যা আর অস্বীকার করার উপায় রাখে না।
দুর্ভিক্ষ সাধারণত একটি তীব্র পুষ্টিহীনতার পরিস্থিতিকে বোঝায়, যার ফলে একটি জনগোষ্ঠী বা পুরো জনসংখ্যার না খেয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক আইনে এই ধারণাটির জন্য কোনো সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই।
তবে ২০০৪ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) “ইনটিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন” (আইপিসি) নামে একটি পাঁচ-ধাপের পরিমাণভিত্তিক মানবিক স্কেল তৈরি করে, যার মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার মানচিত্র তৈরি করা হয়।
এই মূল্যায়ন পদ্ধতির উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেখানেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা চিহ্নিত হবে, সেখানেই সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আইপিসি স্কেলের স্তর ৫-এ পৌঁছানোর আগেই থামানো; কারণ স্তর ৫ মানে নিশ্চিত দুর্ভিক্ষ ঘোষণা। গত ২০ বছর ধরে এফএও, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও তাদের অংশীদাররা এই বৈজ্ঞানিক, তথ্যভিত্তিক পদ্ধতিটি ব্যবহার করে আসছেন।
গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণার জন্য আইপিসির মানদণ্ড ভয়াবহভাবে স্পষ্ট
যদি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের অন্তত ২০ শতাংশ পরিবারের মধ্যে চরম খাদ্যসংকট বিরাজ করে এবং তাদের তা মোকাবিলার সামর্থ্য খুবই সীমিত; শিশুদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টির হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় এবং প্রতিদিন প্রতি ১০ হাজার ০০০ জনে দুজনের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে; এই তিনটি শর্ত একসঙ্গে বিরাজ করলেই তখন ‘দুর্ভিক্ষ’ ঘোষণা করা উচিত। যদিও এটি কোনো আইনি বা চুক্তিভিত্তিক বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে না, তবু এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা হয়ে দাঁড়ায়, যা আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাকে সক্রিয় করার জন্য জোরালো সংকেত দেয়।
বিশেষজ্ঞরা যদি এক বছর আগেই এককথায় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন যে, অবরুদ্ধ গাজায় দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে, তাহলে এটা বোঝা কঠিন— কেন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং নির্বাহী প্রধানরা ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত এসে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এই মধ্যযুগীয় অবরোধের পরও ‘লেভেল ৫’-এর স্বীকৃতিতে পৌঁছাতে পারেননি।
একবিংশ শতাব্দীর এই বাস্তবতায়, যেখানে বিশ্বের সব প্রান্তে স্মার্টফোনে রিয়েল টাইম তথ্য পৌঁছে যাচ্ছে, সেখানে এমন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মর্মান্তিক বাস্তবতা একদমই অস্বীকারযোগ্য। নাৎসি ঘাঁটির কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তোলা ছবির মতো কঙ্কালসার দেহের দৃশ্য এখন গাজার বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর কঠোর অবরোধ অব্যাহত রয়েছে।
অনাহারে হাড্ডিচর্মসার গাজার তরুণ। আলজাজিরার ছবি।
তবু এমন বাস্তবতার মাঝেও যেখানে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) ২০ জুলাই হুঁশিয়ারি দিয়েছে, গাজার ১০ লাখ শিশু অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে; তারপরও ‘দুর্ভিক্ষ’ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি।
এই ঘোষণার অনুপস্থিতির পেছনে যে কারণটি সামনে আনা হচ্ছে তা হলো, আপিসি পদ্ধতিতে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় তথ্য গাজা থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এটি একেবারে অসম্ভব নয়, কারণ সাংবাদিক এবং অনেক মানবিক সহায়তাকারীকে গাজায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। ফলে আইপিসি বিশ্লেষকদের জন্য সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, যেটা তারা বিশ্বের আরো প্রায় ৩০টি পরিস্থিতিতে করতে পারেন। কিন্তু যখন বাস্তবতা চোখের সামনে স্পষ্ট, যখন কিছু নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তখন মানবিক বিবেচনাতেই প্রযুক্তিগত মানদণ্ডকে অগ্রাহ্য করা উচিত।
কিন্তু আজকের জাতিসংঘ কাঠামো একটি সংস্কৃতির মধ্যে আটকে আছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বেপরোয়া প্রশাসনিক প্রভাব সবকিছুতে প্রাধান্য পাচ্ছে। পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিকতার বদলে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা নেতৃত্বে রয়েছেন, তারা কী সঠিক সেটা জানেন (বা অন্তত জানা উচিত; তবে সেই সত্য তাদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলেই তারা চুপ করে থাকেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি করিম খান এবং জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদনকারী ফ্রানচেসকা আলবানিজের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যেভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই দায়িত্বগুলো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। আলবানিজের ক্ষেত্রে তো তার এই কাজটিই একটি চাকরি নয়; তিনি এটি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে করছেন, যা তার সাহস ও নিষ্ঠাকে আরো বেশি প্রশংসনীয় করে তোলে।
স্বীকার করতে হয়, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মতো নির্বাহী প্রধানদের জন্য পরিস্থিতি অনেক জটিল; কারণ তারা যেসব সংস্থা পরিচালনা করেন, সেগুলোর ওপর কিছু প্রভাবশালী দেশের শাস্তিমূলক পদক্ষেপের হুমকি সবসময়ই থাকে। প্রবাদে যেমন বলা হয়, ‘টাকা কথা বলে’, আর জাতিসংঘ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় অর্থদাতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু এখন যেহেতু মার্কিন কংগ্রেস এক নজিরবিহীন বিল পাস করে জাতিসংঘকে তহবিল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধের ভয় দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘ সংস্থাগুলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখা আর কোনো গ্রহণযোগ্য অজুহাত হতে পারে না; যদি কখনো তা হয়ে থাকে।
এখানে মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সংবিধিতে বলা আছে, আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাতে বেসামরিক জনগণকে না খাইয়ে রাখা একটি যুদ্ধাপরাধ। ২ মার্চ থেকে গাজায় যে পূর্ণ অবরোধ চলছে এবং যার ফলে বেসামরিক মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও নবজাতকেরা অনাহারে মারা যাচ্ছে, তা স্পষ্টভাবে আইসিসির ধারা ৮-এর আওতাভুক্ত। এটি আরো স্পষ্ট, কারণ এই অবরোধ একটি ইচ্ছাকৃত ও ঘোষিত নীতির ফল, যার মাধ্যমে মাসের পর মাস ধরে মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে।
এই মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে ফিলিস্তিনিরা ধীরে ধীরে অনাহারে মৃত্যুবরণ করছে অথচ বিশ্ব নীরব। অপরদিকে মিশরের সীমান্তে টনকে টন খাবার পচে যাচ্ছে, কেবল গাজায় প্রবেশের অনুমতির অপেক্ষায়। গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন কর্তৃক নিয়োজিত ইসরায়েলি সেনারা ও বিদেশি ভাড়াটে সৈন্যরা তথাকথিত মানবিক সহায়তা কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য নিতে আসা ৯০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মতে, প্রায় ৯০ হাজার নারী ও শিশু রঅপুষ্টির কারণে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, শুধু ২০ জুলাই এক দিনেই ১৯ জন মানুষ অনাহারে মারা গেছে। এবং পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে চলেছে।
মাইকেল ফাখরি, পেদ্রো অ্যারোহো-আগুদো এবং ফ্রানচেসকা আলবানিজে এক বছর আগেই বলে দিয়েছিলেন, এখন সময় এসে গেছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার, ‘গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে।’
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা মোনসেফ খান।
[লেখক পরিচিতি: মোনসেফ খান জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা, যিনি মানবাধিকার, রাজনৈতিক বিষয়াবলি, শান্তিরক্ষা ও বিশেষ রাজনৈতিক মিশন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ এবং মহাসচিব কফি আনানের নির্বাহী দপ্তরে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট এবং জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ডিপ্লোমেসিতে ফেলো ছিলেন। তিনি ফ্লেচার স্কুল অব ল’ অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি এবং কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তার এই লেখাটি ২১ জুলাই আলজাজিরা প্রকাশ করেছে।]