আকরাম বশিরের সন্তানরা ক্ষুধায় সারাক্ষণ কাঁদে। তিনি কেবল তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলার চেষ্টা করেন, “একদিন, যখন ইসরায়েলি অবরোধ শেষ হবে, তখন তোমরা যা খুশি খেতে পারবে।”
কিন্তু এই তিন সন্তানের ফিলিস্তিনি বাবা জানেন, তিনি এমন একটি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, যা তিনি রাখতে পারবেন না।
বশির বলেন, “আমি কিছুই করতে পারি না। আমি শুধু মানসিকভাবে তাদের সাহস জোগাই। বলি, ‘ইনশাআল্লাহ, পরিস্থিতি ভালো হবে, খাবার পাওয়া যাবে।’ এর বাইরে আর কিছু করার নেই।”
গাজার কেন্দ্রীয় এলাকার দেইর আল-বালাহতে বসবাসরত ৩৯ বছর বয়সি বশির প্রতিদিনই খাবারের খোঁজে ছোটেন;শুধু যেন তার সন্তানদের এবং অসুস্থ ও বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বাবা-মাকে একটু খাবার দিতে পারেন, যাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা দিন দিন শুধু খারাপই হচ্ছে।
গাজার আনুমানিক ২১ লাখ মানুষের মতোই বশির ও তার পরিবার মার্চ মাস থেকে আরোপিত ইসরায়েলের সম্পূর্ণ অবরোধের কারণে চরম ক্ষুধায় দিন কাটাচ্ছে। হাড্ডিচর্মসার এই ফিলিস্তিনিদের অনেকে এখন রাস্তায় ও আশ্রয়শিবিরে ঢলে পড়ছে।
মাঝে মাঝে বশিরের পরিবার এক বেলার খাবার সংগ্রহ করতে পারে। অনেক সময় তাও পায় না।
“ক্ষুধার কারণে আমার সন্তানদের মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে,” বলেন বশির।
“তারা ওজন হারাচ্ছে, অতিরিক্ত ঘুমাচ্ছে, মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না। সারা দিন তারা কেবল খাবারের কথাই ভাবে, বিশেষ করে মিষ্টিজাতীয় কিছু। তারা বারবার বলে, তারা ক্ষুধার্ত।”
বশির যদি তাদের জন্য কিছু খাবার জোগাড় করে আনতে পারেন, তাতে পুষ্টি থাকে পর্যাপ্ত। ফলে ক্ষুধা থেকেই যায়।
“তারা কখনোই পরিপূর্ণভাবে খেতে পারে না। খাবারে পুষ্টিগুণ নেই, সেটা তাদের তৃপ্ত করে না,” বলেন বশির।
তিনি যোগ করেন, “প্রাপ্তবয়স্করাও তেমন ভালো নেই। আমরা সবাই ওজন হারিয়েছি। সামান্য পরিশ্রমেই পুরোপুরি ক্লান্ত হয়ে পড়ি।”
তবুও বশির বিশ্বাস করেন, যতটুকু খাবারই পান না কেন, তা দিয়েই অন্তত সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা তার বাবা-মাকে নিয়ে। তারা বৃদ্ধ ও অসুস্থ। তার বাবা ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।
“তিনি একাধিকবার মাথা ঘোরা ও দুর্বলতার কারণে অচেতন হয়ে পড়েছেন,” বলেন বশির।
“আমাদের সবসময় তাকে নজরে রাখতে হয়। সম্প্রতি তিনি পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছেন। আর দুধ নেই, ডিম নেই, কোনো পুষ্টিকর খাবার নেই; ফলে তার হাড় ভালো হচ্ছেই না।”
মাসব্যাপী অবরোধে দুর্ভিক্ষ
২ মার্চ গাজার সীমান্ত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। ফলে গাজায় প্রায় সব ধরনের সহায়তা ও পণ্য সরবরাহ- যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার, শিশুখাদ্য ও পানীয় জল বন্ধ হয়ে যায়।
ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশনের (আইপিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাস পর্যন্ত গাজার প্রায় ৫ লাখ মানুষ চরম খাদ্য সংকটে ভুগছিল। এরপর পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে গেছে, যার ফলে গাজার পুরো ২১ লাখ মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের মুখে।
“সংকট শুরু হয়েছিল যখন দখলদার বাহিনী রমজানের শুরুতে ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দেয় কিন্তু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয় দেড় মাস আগে, যখন আমাদের জমিয়ে রাখা খাদ্যও ফুরিয়ে যায়,” বলেন বশির।
“শেষ পর্যন্ত তো তা চিরদিনের জন্য চলতে পারে না। আমরা একটি পুরো পরিবার, যেখানে শিশুদের নিয়মিত খাবার প্রয়োজন। আর যত দীর্ঘসময় যাচ্ছে, ততই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী পাওয়া কঠিন হয়ে উঠছে।”
খাবারের জন্য চিৎকার করে কাঁদছে গাজার শিশুরা। মিডল ইস্ট আই-এর ছবি।
জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সি বাসেম মুনির আল-হিন্নাওয়ি। তার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের তীব্র সংকট শুরু হয়েছে কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই। গত এক মাসে তিনি ও তার পরিবার গড়ে প্রতি চার-পাঁচ দিন পরপর একবার রুটি খেতে পেরেছেন।
যুদ্ধের শুরুতেই বাবাকে হারানোর পর এখন তিনি দুই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি বলছিলেন, “এখন আমি আমার মা, বোনেরা, দুই ভাই, স্ত্রী এবং এক বছরের সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্বে।”
আল-হিন্নাওয়ি বলেন, “যেদিন রুটি পাই না, সেদিন আমি মাঝে মাঝে বাচ্চাদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য অল্প একটু শর্টব্রেড বিস্কুট কিনে দিই। আর যদি ডাল পাওয়া যায়, তখন আমরা ডালের স্যুপ রান্না করি।”
মানুষ ক্ষুধায় ভেঙে পড়ছে, ঢলে পড়ছে
হিন্নাওয়ি বলেন, অবরোধের শুরুর মাসগুলোতেই টানা ক্ষুধা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অপুষ্টিজনিত শারীরিক ধকল এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে, তা আর সহ্য করার মতো নয়। তারা দুর্বল হয়ে পড়ছেন, মাথা ঘুরছে, স্বাভাবিক কাজকর্মও করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
“সাম্প্রতিক সময়ে আমি চরম ক্লান্তিতে ভুগছি, সহজে চলাফেরা করতে পারি না। আমার সবসময় মাথা ঘোরে এবং আমি ভীষণরকম কৃশকায় হয়ে গেছি। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমি ৩৯ কেজি ওজন হারিয়েছি। আমার ভাইবোনদের প্রত্যেকের ১৫ থেকে ২০ কেজি ওজন কমে গেছে,” যোগ করেন তিনি।
“প্রতি কয়েকদিন পরপরই আমাদের আমার বোনকে হাসপাতালে নিতে হয়, কারণ অপুষ্টির কারণে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আর আমার স্ত্রী, যিনি এখনো স্তন্যদান করছেন, তিনি আরো চরম ক্লান্তি, মাথা ঘোরা ও দুর্বলতায় ভুগছেন। তিনি গৃহের সাধারণ কাজও আর সামাল দিতে পারেন না।”
যখন আল-হিন্নাওয়ি কোনোভাবে সামান্য খাবার জোগাড় করতে পারেন, তা শুধুই শিশুদের জন্য তুলে রাখেন। প্রাপ্তবয়স্করা কেবল পানি আর লবণ খেয়ে বেঁচে থাকেন।
“আমি সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রে পাঁচবার গিয়েছি, কিন্তু প্রতিবারই খাবার না পেয়ে ফিরে এসেছি। সেখানে আমি চরম বিপদের মধ্যে পড়েছি, ট্যাংক আর কোয়াডকপ্টারের গুলির মুখোমুখিও হয়েছি,” স্মরণ করে বলেন তিনি।
আল-হিন্নাওয়ি বলেন, “প্রতিবারই আমি খালি হাতে ফিরে এসেছি। আল্লাহর কসম, এমন দিন গেছে যখন আমরা প্রাপ্তবয়স্করা টানা চার দিন কিছু না খেয়ে শুধু লবণগোলা পানি খেয়েই কাটিয়েছি,” যোগ করেন।
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন আল-হিন্নাওয়ির মা। তিনি ২০ মিটার হাঁটতেও পারেন না; হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করলেই পড়ে যান।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের যুদ্ধ ও অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত ১২৭ জন শুধু অনাহারে ভুগে মারা গেছেন, যার মধ্যে অন্তত ৮৫ জন শিশু।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা অপুষ্টির ২৮ হাজারটিরও বেশি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি।
“আমরা প্রাপ্তবয়স্করা কখনো কখনো এই ক্ষুধা সহ্য করে নিতে পারি। কিন্তু একটা ছোট শিশু কীভাবে বুঝবে যে, আমাদের ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রাখা হচ্ছে?” যোগ করেন হিন্নাওয়ি।
“তারা কীভাবে বুঝবে যে, তারা খাবার পাচ্ছে না; কারণ তাদের বাবা-মা চাচ্ছে না, যা সত্যও না।”
যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বাজার থেকে পুরোপুরি উধাও এবং পরিবারগুলো দিনের পর দিন খাদ্যের অভাবে কাটাচ্ছে, তখন গাজার রাস্তায় ক্ষুধা ও চরম ক্লান্তিতে মানুষের ঢলে পড়ার দৃশ্য দিন দিন আরো সাধারণ হয়ে উঠেছে।
“এই তো গতকাল, আমি শেখ রাদওয়ানে হাঁটছিলাম; যেখানে আমি এখন আশ্রয় নিয়েছি। একজন প্রায় ৪০-এর কোঠার নারী রাস্তার মাঝখানে ক্ষুধায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন,” বলছিলেন হিন্নাওয়ি।
দুঃখ-কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে তার দেখা ঘটনার কথা স্মরণ করে হিন্নাওয়ি বলেন, “লোকেরা তাকে তুলে রাস্তার পাশে বসিয়ে রাখে। এরপর কোনো একজন তার বাড়ি থেকে সামান্য একটু চিনি নিয়ে আসে, যা এখন ভীষণভাবে দুর্লভ। চিনিটকু তাকে খাওয়ায়। ধীরে ধীরে তিনি জ্ঞান ফিরে পান ও উঠে দাঁড়ান। “মনুষ আসলেই বিধ্বস্ত। আর এভাবে চলতে পারে না।”