০৩:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নির্বাচনে ‘অবিচল’ সরকার, যে যার শর্তে ‘অটল’ রাজনৈতিক দল

  • Voice24 Admin
  • সময়ঃ ১২:০৩:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ নভেম্বর ২০২৫
  • ৫৫২ Time View

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের দিন-তারিখ নিয়ে মতপার্থক্যের পারদ চড়তে থাকলেও যথাসময়ে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে অবিচল মনোভাবের কথা বারবার উচ্চারণ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। 

বিএনপি, গণঅধিকার পরিষদসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো স্পষ্ট ভাষায় অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় ঐক্যের প্রচেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলছে, সরকার ও ঐকমত্য কমিশন টালবাহানা করছে।

আবার ‘হ্যাঁ’, ‘না’ গণভোট নিয়ে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর দাবিকেও অযৌক্তিক ও প্রতারণার কৌশল বলছে বিএনপি। তবে জামায়াত ও এনসিপি জোর গলায় বলছে, নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোট হতে হবে এবং প্রধান উপদেষ্টার আদেশের মাধ্যমে আইনি ভিত্তি দিতে হবে।

এ ছাড়া সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির নির্বাচনও চাইছে জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা ইসলামী দলগুলো। 

এ অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করার বিষয়ে সরকারের ‘অবিচল’ অবস্থানকে সংশয়পূর্ণ করে তুলছে যারা যার শর্তে ‘অটল’ রাজনৈতিক দল বা দলীয় পক্ষগুলো। 

‘কোনো উত্তাপই নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না’
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, যিনি সরকারের মুখপাত্র হিসেবে বিবেচিত, তিনি বলেছেন, “রাজনৈতিক দল থাকলে মতবিরোধ থাকবে, এক এক পার্টি এক এক কথা বলবে, এটাই নিয়ম; সারা বিশ্বে এমনই হয়। তবে কোনো উত্তাপই নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না।”

গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সরকারের হাতে, এমন অবস্থান তুলে ধরে শফিকুল আলম বলেছেন, “গণভোটের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে। সিদ্ধান্ত যাই হোক, ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই জাতীয় নির্বাচন হবে। কারণ সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এটা ঠেকানোর কোনো শক্তিই নাই।”

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামে জুলাই কন্যা ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘মাইন্ড ব্রিজ অ্যান্ড নলেজ কম্পিটিশন’-এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

সবাইকে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ করে শফিকুল আলম বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা দেশের মানুষের মঙ্গলে, গণতন্ত্রের স্বার্থে এবং সব দলের জন্য মঙ্গল হয়; এমন সব কাজই করবেন। ইতোমধ্যে সরকার জুলাই সনদ ডিক্লার (ঘোষণা) করেছে, জুলাই সনদে স্বাক্ষর হয়েছে। এর আগে, অনেকগুলো কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে, অর্থনীতিকে পুনরদ্ধার করা গেছে, ট্রায়ালের কাজগুলো হচ্ছে।”

বিএনপি বলছে, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের সুযোগ নেই’
‘জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের কোনো সুযোগ নেই’ বলে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট করার দাবিতে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে জেএসডির এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব তার দলের এই অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। 

বিএনপির মহাসচিব বলেন, “আমি খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমরা নির্বাচন করব, নির্বাচন করতে চাই। আমরা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যে ঘোষণা দিয়েছেন; সেই ঘোষণার সঙ্গে একমত হয়ে আমরা নির্বাচন চাই।”

মির্জা ফখরুল বলেন, “নির্বাচন বানচাল করার জন্য, নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য একটা মহল উঠে পড়ে লেগেছে। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কথাবার্তা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা পরিষ্কার বলতে চাই, গণভোট নির্বাচনের আগে করার সুযোগ এখন আর নাই।”

নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, “সে কথা আমরা পরিষ্কার করে বলেছি। সেখানে দুটা কারণ থাকবে, একটি ভোট গণভোটের জন্য, আরেকটি ভোট হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। সুতরাং এই বিষয়ে কোনো দ্বিমত কারো থাকবে বলে আমি অন্তত মনে করি না।”

অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ বিএনপির

প্রেস ক্লাবের একই অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে দেশ ও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা করার মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছেন।

জুলাই সনদ সইয়ের পর তাতে পরিবর্তন করার তীব্র সমালোচনা করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, “দেখা গেল, যখন এটা (সুপারিশ) তারা (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) উপস্থাপন করল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে, তখন সেটায় অনেক পার্থক্য। বিশেষ করে আমরা যে নোট অব ডিসেন্টগুলো দিয়েছিলাম, সেগুলো যেন সুপারিশে উল্লেখ করা হয়, তেমনটা বলেছিলাম। এ ব্যাপারে আমরা আস্থা-বিশ্বাস রেখেছিলেন। কিন্তু সেই আস্থা, বিশ্বাসের সঙ্গে তারা বিশ্বাসঘাতক করেছে।”

অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশন ‘জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে’ বলে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, এটা তারা তাদের কাছ থেকে আশা করেননি।

তিনি বলেন, ‘‘আমার হাতে যে জুলাই জাতীয় সনদের বইটা দেখছেন, এখানে সংস্কার কমিশন এবং অন্যদের প্রস্তাবের বিপরীতে এগুলো লেখা হয়েছে। এখানে নোট অব ডিসেন্ট শুধু আমরা দেইনি, এখানে বিভিন্ন দল বিভিন্ন দফায় বিভিন্ন রকমের নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। সেটা এভাবেই উল্লেখ আছে এবং দফাওয়ারি এ কথাগুলোই আছে।

‘‘এখন আমাদের প্রশ্ন হলো, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য এগুলো কি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল না? কিন্তু তারা (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) জুলাই জাতীয় সনদের পুস্তকের ডান পাশের সমস্ত মতামত বাদ দিয়ে দিয়েছে। তারা শুধু নিজেদের প্রস্তাবগুলোর ওপরে একটা তফসিল রচনা করেছেন।”

তিনি বলেন, “৪৮টা দফা দিয়ে সেই তফসিল করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই ৪৮ দফার ওপরেই গণভোট হবে। এখানে কে কী মতামত দিল, কীভাবে উল্লেখ করা হলো, কীভাবে সম্মত হলো, কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।”

‘জাতিকে বিভ্রান্ত করছে কমিশন’
ওই সংবাদ সম্মেলনে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘‘এই সমস্ত পরিকল্পনা বা প্রস্তাব হঠাৎ করে নিয়ে সুপারিশ দেওয়া এবং জাতিকে বিভ্রান্ত করা, এখানে অনৈক্য সৃষ্টি করা, বিভক্ত করা তো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কর্ম হতে পারে না।

“এখন দেখতে পারছি, অনৈক্য সৃষ্টি করছে, বিভক্তি সৃষ্টি করছে। সেটার কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, আমরা জানি না।”

জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ড. ইউনূস সংস্কার করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি করেছেন: মান্না
‘উপদেষ্টারা অপদার্থ, তারা নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করেছেন’ বলে কড়া মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিকভাবে বর্তমানে বিএনপির সমমনা দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তারা ভাষায়, “ড. ইউনূস সংস্কার করতে গিয়ে আরো সমস্যা সৃষ্টি করেছেন।”

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে এই মন্তব্য করেন তিনি।

মান্না বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ সইয়ের পর সংশোধনের অধিকার সরকারকে কেউ দেয়নি। গায়ের জোরে মূর্খের মতো সনদ সংশোধন করা হয়েছে। জুলাই সনদের প্রস্তাবনা থেকে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি প্রতারণা। সনদ সইয়ের দিন ৫ নম্বর দফা পরিবর্তন করা হয়েছে। আবার ঐকমত্য কমিশন ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সনদে পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের কথা বলেছে। কিন্তু সনদ স্বাক্ষরের পর তা পরিবর্তন করার অধিকার তাদের কেউ দেয়নি।”

বিএনপির বিরুদ্ধে ‘পল্টি নেওয়ার’ অভিযোগ জামায়াতের
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার এলাকায় কুমিল্লা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ মিলনায়তনে শুক্রবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে একমত হয়ে আমরা সবাই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছি।”

গণভোট নির্বাচনের আগে করার বিষয়ে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “সবকিছু পর্যালোচনা শেষে সবাই একমত হয়েছি, একটি সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদকে গ্রহণ করা হবে এবং এটার ওপর একটা গণভোট হবে। গণভোটের পর যে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সংসদের মাধ্যমে ২৭০ দিনে এটাকে সংবিধানে যুক্ত করা হবে। সবকিছু ঠিক, আমরাও রাজি, বিএনপিও রাজি। কিন্তু হঠাৎ করেই বিএনপি পল্টি নিয়েছে।”

“তারা (বিএনপি) এত দিন ধরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে থেকে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পর এখন বলছে, আমরা এটাকে মানি না। বিএনপি বর্তমানে অন্যায়ভাবে এই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে,” বলেন জামায়াত নেতা ডা. তাহের।

জামায়াতের এই নেতাকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে তাদের দলের পক্ষে প্রায় সব বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায়। বৈঠকের বিষয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে তিনি ব্রিফেও অংশ নেন। 

‘জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের কোনো বাস্তবতা নেই’
জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের কোনো বাস্তবতা নেই বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাজধানীর পল্লবী এলাকায় শ্রমিক সমাবেশের বক্তৃতায় এই মন্তব্য করেন তিনি।

নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, “নির্বাচন ডাকাতি স্থায়ীভাবে থামাতে সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। যারা জনগণের ভোটের মূল্যায়ন করতে চায় না, তারাই এখন গণভোট বানচাল করার চেষ্টা করছে। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের কোনো বাস্তবতা নেই।”

দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য তিনি একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তুলে ধরেন। মুজিবুর রহমান বলেন, “আগে বিচার-সংস্কার, তারপর জাতীয় নির্বাচন হবে।”

আগে জুলাই সনদের আইনি স্বীকৃতি চায় এনসিপি
পিরোজপুরে এনসিপির এক সমন্বয় সভায় যোগ দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “অতি দ্রুত গণভোট নিয়ে অর্ডার (আদেশ) হতে হবে।”

‘আদেশের আলোচনাটি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে’ বলে অভিযোগ তুলে হাসনাত বলেন, “আমরা চাই, অতি দ্রুত আদেশের বিষয়টি নিষ্পত্তি হোক এবং এই আদেশটি কোনো অধ্যাদেশ নয়, কোনো প্রজ্ঞাপন নয়, অবশ্যই আদেশ হতে হবে।”

আদেশটি রাষ্ট্রপতি জারি করলে হবে না জানিয়ে হাসনাত বলেন, “এই আদেশটি আমাদের এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যিনি প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন- ড. মোহাম্মদ ইউনূস; আদেশটি তাকেই জারি করতে হবে।”

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার ফরিদপুর শহরে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগ তুলেছেন। 

তিনি বলেছেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নামে জাতির সঙ্গে ‘মহা প্রতারণা’ করা হয়েছে।” 

“আমরা দেশে ‘নতুন কোনো আওয়ামী লীগ’ দেখতে চাই না এবং সনদের আইনি স্বীকৃতির জন্য অবিলম্বে গণভোট দরকার,” বলেন তুষার। 

ট্যাগঃ

নির্বাচনে ‘অবিচল’ সরকার, যে যার শর্তে ‘অটল’ রাজনৈতিক দল

সময়ঃ ১২:০৩:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ নভেম্বর ২০২৫

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের দিন-তারিখ নিয়ে মতপার্থক্যের পারদ চড়তে থাকলেও যথাসময়ে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে অবিচল মনোভাবের কথা বারবার উচ্চারণ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। 

বিএনপি, গণঅধিকার পরিষদসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো স্পষ্ট ভাষায় অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় ঐক্যের প্রচেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলছে, সরকার ও ঐকমত্য কমিশন টালবাহানা করছে।

আবার ‘হ্যাঁ’, ‘না’ গণভোট নিয়ে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর দাবিকেও অযৌক্তিক ও প্রতারণার কৌশল বলছে বিএনপি। তবে জামায়াত ও এনসিপি জোর গলায় বলছে, নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোট হতে হবে এবং প্রধান উপদেষ্টার আদেশের মাধ্যমে আইনি ভিত্তি দিতে হবে।

এ ছাড়া সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির নির্বাচনও চাইছে জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা ইসলামী দলগুলো। 

এ অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করার বিষয়ে সরকারের ‘অবিচল’ অবস্থানকে সংশয়পূর্ণ করে তুলছে যারা যার শর্তে ‘অটল’ রাজনৈতিক দল বা দলীয় পক্ষগুলো। 

‘কোনো উত্তাপই নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না’
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, যিনি সরকারের মুখপাত্র হিসেবে বিবেচিত, তিনি বলেছেন, “রাজনৈতিক দল থাকলে মতবিরোধ থাকবে, এক এক পার্টি এক এক কথা বলবে, এটাই নিয়ম; সারা বিশ্বে এমনই হয়। তবে কোনো উত্তাপই নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না।”

গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সরকারের হাতে, এমন অবস্থান তুলে ধরে শফিকুল আলম বলেছেন, “গণভোটের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে। সিদ্ধান্ত যাই হোক, ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই জাতীয় নির্বাচন হবে। কারণ সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এটা ঠেকানোর কোনো শক্তিই নাই।”

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামে জুলাই কন্যা ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘মাইন্ড ব্রিজ অ্যান্ড নলেজ কম্পিটিশন’-এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

সবাইকে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ করে শফিকুল আলম বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা দেশের মানুষের মঙ্গলে, গণতন্ত্রের স্বার্থে এবং সব দলের জন্য মঙ্গল হয়; এমন সব কাজই করবেন। ইতোমধ্যে সরকার জুলাই সনদ ডিক্লার (ঘোষণা) করেছে, জুলাই সনদে স্বাক্ষর হয়েছে। এর আগে, অনেকগুলো কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে, অর্থনীতিকে পুনরদ্ধার করা গেছে, ট্রায়ালের কাজগুলো হচ্ছে।”

বিএনপি বলছে, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের সুযোগ নেই’
‘জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের কোনো সুযোগ নেই’ বলে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট করার দাবিতে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে জেএসডির এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব তার দলের এই অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। 

বিএনপির মহাসচিব বলেন, “আমি খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমরা নির্বাচন করব, নির্বাচন করতে চাই। আমরা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যে ঘোষণা দিয়েছেন; সেই ঘোষণার সঙ্গে একমত হয়ে আমরা নির্বাচন চাই।”

মির্জা ফখরুল বলেন, “নির্বাচন বানচাল করার জন্য, নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য একটা মহল উঠে পড়ে লেগেছে। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কথাবার্তা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা পরিষ্কার বলতে চাই, গণভোট নির্বাচনের আগে করার সুযোগ এখন আর নাই।”

নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, “সে কথা আমরা পরিষ্কার করে বলেছি। সেখানে দুটা কারণ থাকবে, একটি ভোট গণভোটের জন্য, আরেকটি ভোট হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। সুতরাং এই বিষয়ে কোনো দ্বিমত কারো থাকবে বলে আমি অন্তত মনে করি না।”

অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ বিএনপির

প্রেস ক্লাবের একই অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে দেশ ও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা করার মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছেন।

জুলাই সনদ সইয়ের পর তাতে পরিবর্তন করার তীব্র সমালোচনা করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, “দেখা গেল, যখন এটা (সুপারিশ) তারা (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) উপস্থাপন করল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে, তখন সেটায় অনেক পার্থক্য। বিশেষ করে আমরা যে নোট অব ডিসেন্টগুলো দিয়েছিলাম, সেগুলো যেন সুপারিশে উল্লেখ করা হয়, তেমনটা বলেছিলাম। এ ব্যাপারে আমরা আস্থা-বিশ্বাস রেখেছিলেন। কিন্তু সেই আস্থা, বিশ্বাসের সঙ্গে তারা বিশ্বাসঘাতক করেছে।”

অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশন ‘জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে’ বলে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, এটা তারা তাদের কাছ থেকে আশা করেননি।

তিনি বলেন, ‘‘আমার হাতে যে জুলাই জাতীয় সনদের বইটা দেখছেন, এখানে সংস্কার কমিশন এবং অন্যদের প্রস্তাবের বিপরীতে এগুলো লেখা হয়েছে। এখানে নোট অব ডিসেন্ট শুধু আমরা দেইনি, এখানে বিভিন্ন দল বিভিন্ন দফায় বিভিন্ন রকমের নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। সেটা এভাবেই উল্লেখ আছে এবং দফাওয়ারি এ কথাগুলোই আছে।

‘‘এখন আমাদের প্রশ্ন হলো, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য এগুলো কি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল না? কিন্তু তারা (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) জুলাই জাতীয় সনদের পুস্তকের ডান পাশের সমস্ত মতামত বাদ দিয়ে দিয়েছে। তারা শুধু নিজেদের প্রস্তাবগুলোর ওপরে একটা তফসিল রচনা করেছেন।”

তিনি বলেন, “৪৮টা দফা দিয়ে সেই তফসিল করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই ৪৮ দফার ওপরেই গণভোট হবে। এখানে কে কী মতামত দিল, কীভাবে উল্লেখ করা হলো, কীভাবে সম্মত হলো, কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।”

‘জাতিকে বিভ্রান্ত করছে কমিশন’
ওই সংবাদ সম্মেলনে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘‘এই সমস্ত পরিকল্পনা বা প্রস্তাব হঠাৎ করে নিয়ে সুপারিশ দেওয়া এবং জাতিকে বিভ্রান্ত করা, এখানে অনৈক্য সৃষ্টি করা, বিভক্ত করা তো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কর্ম হতে পারে না।

“এখন দেখতে পারছি, অনৈক্য সৃষ্টি করছে, বিভক্তি সৃষ্টি করছে। সেটার কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, আমরা জানি না।”

জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ড. ইউনূস সংস্কার করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি করেছেন: মান্না
‘উপদেষ্টারা অপদার্থ, তারা নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করেছেন’ বলে কড়া মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিকভাবে বর্তমানে বিএনপির সমমনা দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তারা ভাষায়, “ড. ইউনূস সংস্কার করতে গিয়ে আরো সমস্যা সৃষ্টি করেছেন।”

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে এই মন্তব্য করেন তিনি।

মান্না বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ সইয়ের পর সংশোধনের অধিকার সরকারকে কেউ দেয়নি। গায়ের জোরে মূর্খের মতো সনদ সংশোধন করা হয়েছে। জুলাই সনদের প্রস্তাবনা থেকে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি প্রতারণা। সনদ সইয়ের দিন ৫ নম্বর দফা পরিবর্তন করা হয়েছে। আবার ঐকমত্য কমিশন ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সনদে পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের কথা বলেছে। কিন্তু সনদ স্বাক্ষরের পর তা পরিবর্তন করার অধিকার তাদের কেউ দেয়নি।”

বিএনপির বিরুদ্ধে ‘পল্টি নেওয়ার’ অভিযোগ জামায়াতের
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার এলাকায় কুমিল্লা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ মিলনায়তনে শুক্রবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে একমত হয়ে আমরা সবাই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছি।”

গণভোট নির্বাচনের আগে করার বিষয়ে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “সবকিছু পর্যালোচনা শেষে সবাই একমত হয়েছি, একটি সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদকে গ্রহণ করা হবে এবং এটার ওপর একটা গণভোট হবে। গণভোটের পর যে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সংসদের মাধ্যমে ২৭০ দিনে এটাকে সংবিধানে যুক্ত করা হবে। সবকিছু ঠিক, আমরাও রাজি, বিএনপিও রাজি। কিন্তু হঠাৎ করেই বিএনপি পল্টি নিয়েছে।”

“তারা (বিএনপি) এত দিন ধরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে থেকে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পর এখন বলছে, আমরা এটাকে মানি না। বিএনপি বর্তমানে অন্যায়ভাবে এই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে,” বলেন জামায়াত নেতা ডা. তাহের।

জামায়াতের এই নেতাকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে তাদের দলের পক্ষে প্রায় সব বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায়। বৈঠকের বিষয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে তিনি ব্রিফেও অংশ নেন। 

‘জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের কোনো বাস্তবতা নেই’
জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের কোনো বাস্তবতা নেই বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাজধানীর পল্লবী এলাকায় শ্রমিক সমাবেশের বক্তৃতায় এই মন্তব্য করেন তিনি।

নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, “নির্বাচন ডাকাতি স্থায়ীভাবে থামাতে সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। যারা জনগণের ভোটের মূল্যায়ন করতে চায় না, তারাই এখন গণভোট বানচাল করার চেষ্টা করছে। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের কোনো বাস্তবতা নেই।”

দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য তিনি একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তুলে ধরেন। মুজিবুর রহমান বলেন, “আগে বিচার-সংস্কার, তারপর জাতীয় নির্বাচন হবে।”

আগে জুলাই সনদের আইনি স্বীকৃতি চায় এনসিপি
পিরোজপুরে এনসিপির এক সমন্বয় সভায় যোগ দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “অতি দ্রুত গণভোট নিয়ে অর্ডার (আদেশ) হতে হবে।”

‘আদেশের আলোচনাটি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে’ বলে অভিযোগ তুলে হাসনাত বলেন, “আমরা চাই, অতি দ্রুত আদেশের বিষয়টি নিষ্পত্তি হোক এবং এই আদেশটি কোনো অধ্যাদেশ নয়, কোনো প্রজ্ঞাপন নয়, অবশ্যই আদেশ হতে হবে।”

আদেশটি রাষ্ট্রপতি জারি করলে হবে না জানিয়ে হাসনাত বলেন, “এই আদেশটি আমাদের এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যিনি প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন- ড. মোহাম্মদ ইউনূস; আদেশটি তাকেই জারি করতে হবে।”

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার ফরিদপুর শহরে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগ তুলেছেন। 

তিনি বলেছেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নামে জাতির সঙ্গে ‘মহা প্রতারণা’ করা হয়েছে।” 

“আমরা দেশে ‘নতুন কোনো আওয়ামী লীগ’ দেখতে চাই না এবং সনদের আইনি স্বীকৃতির জন্য অবিলম্বে গণভোট দরকার,” বলেন তুষার।