নিরাপদ পানি-স্যানিটেশন-স্বাস্থ্যবিধি (ওয়াশ)—বাংলাদেশ এই খাতে অনেক এগিয়ে গেলেও, জাতীয় পর্যায়ে তৈরি নীতি, আইন এবং কৌশলগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা আজও একটি বড় সমস্যা। কেন আমাদের চমৎকার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন পর্যায়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে? প্রধান সমস্যাগুলো কী কী? নীতিতে কি কোনও ফাঁক আছে? বাস্তবের চ্যালেঞ্জ আসলে কোনগুলো? নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পথ পার করলেও, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬ অনুযায়ী ‘নিরাপদ’ ওয়াশ সেবা নিশ্চিত করা একটি আজও বাংলাদেশে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে উন্নত স্যানিটেশন সুবিধার কভারেজ প্রায় ৮৬ শতাংশের বেশি হলেও, এটিকে ‘নিরাপদ’ পর্যায়ে উন্নীত করার ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি রয়েছে।
ওয়াশ-এর কাজের সাথে বহু সরকারি দফতর জড়িত। কিন্তু এই দফতরগুলোর মধ্যে পরিকল্পনা, বাজেট ও তদারকিতে কার্যকর যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। বিশ্লেষকরা এই বহু-খাতভিত্তিক দুর্বল সমন্বয়কে নীতির সফল বাস্তবায়নের একটি প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ড. ক্যাটরিন মেকশাম, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ‘নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের মতো বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সাফল্য নির্ভর করে সরকার, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের ওপর। যদি এই অংশীজনেরা কেবল নিজ গণ্ডিতেই কাজ করে, তবে দীর্ঘদিন ধরে সেবা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।‘ (সূত্র: Charles, K. J. (2018). Intersectoral coordination and water security. Water Security, 4, 1-7.)
নীতিমালা বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব অপর একটি প্রধান বাধা। সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোতে দুর্নীতি, অস্বচ্ছ নিয়োগ এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সঠিক স্থানে, সঠিক সময়ে এবং সঠিক মান অনুযায়ী সেবা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। ‘যদি সুযোগ্য পরিচালনা ও আর্থিক স্বচ্ছতা না থাকে, তবে উন্নত প্রযুক্তিও জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় দুর্বল হয়ে পড়বে। বিনিয়োগ সঠিক জায়গায় পৌঁছনো এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই ভালো ওয়াশ সেবার ভিত্তি।‘ (সূত্র: Gloyd, S. (2020). Corruption and Global Health: An Ethical and Practical Challenge. Springer.)
শুধু অর্থ দিলেই হবে না, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীর অভাব আরও একটি গভীর সমস্যা। বিশেষ করে আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা পরিচালনা এবং জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা দরকার, তারও তীব্র ঘাটতি রয়েছে। জাতীয় নীতি বা কৌশলগুলো সাধারণত গড় হিসেবের ওপর নজর দেয়, ফলে পিছিয়ে পড়া মানুষজন প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রামের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শহরাঞ্চলে পানির সুবিধা ভালো হলেও, গ্রামীণ এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলো লবণাক্ততা ও আর্সেনিক দূষণের কারণে এখনও বড় সমস্যার মুখে রয়েছে।
বাংলাদেশের উপকূল, হাওর এবং চরাঞ্চল লবণাক্ততা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এই অঞ্চলের পানির উৎসগুলো বারবার নষ্ট হয়ে যায়। প্লস ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, দুর্বল নীতি ও কাঠামোগত দুর্বলতা নীতি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে। নীতি বা কৌশল বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে এবং সকলের কাছে ওয়াশ সেবা পৌঁছাতে সরকার, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতের প্রত্যেকেরই ভূমিকা রাখা বাঞ্ছনীয়। ওয়াশ সম্পর্কিত সবগুলো দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি দফতরকে সংশ্লিষ্ট নীতি বা কৌশলপত্র অনুযায়ী নিয়মিত কার্যক্রম গ্রহণ ও পালন করে তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওয়াশ খাতে (বিশেষ করে রক্ষণাবেক্ষণে) নিজস্ব বাজেট ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা দেওয়া ছাড়া এগুনো অসম্ভব।
জাতীয় নীতিগুলোকে স্থানীয় পর্যায়ে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোকে নিজস্ব ‘ওয়াশ মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি এবং সেগুলোকে জাতীয় নীতিমালাগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের এলাকার সুনির্দিষ্ট জলবায়ু ঝুঁকি ও জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও প্রকাশ করতে হবে।
পানির সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যবহারকারী বা সুবিধাভোগীর কাছ থেকে নিয়মিত ও ন্যায্য হারে ফি বা রাজস্ব আদায় করার উদ্যোগ নিতে হবে। এই অর্থ কেবল ওয়াশ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের কাজেই ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। নির্মিত নিরাপদ পানির অবকাঠামো, স্যানিটেশন সুবিধা এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার গুণগত মান নিশ্চিত করতে নিয়মিত মাঠ পর্যায়ের তদারকি করতে হবে এবং জনগণকেও তদারকিতে যুক্ত করতে হবে।
ওয়াশ-এর ক্ষেত্রে আমাদের নীতি-নির্ধারণী কাঠামোটি মজবুত, কিন্তু এর ভেতরের দুর্বলতাগুলোই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে। যদি আমরা আন্তরিকভাবে সমন্বয়, স্বচ্ছতা এবং স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিই, তবেই ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬ অর্জন করা সম্ভব হবে। উন্নত স্যানিটেশন এবং নিরাপদ পানি শুধু একটি সরকারি কাজ নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার এবং দেশের সার্বিক উন্নতির মূল চাবিকাঠি।
লেখক: অ্যাডভোকেট; উন্নয়নকর্মী ও গবেষক
Voice24 Admin 













