০৩:৫৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সংঘচারিতায় উজ্জ্বল আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

  • Voice24 Admin
  • Update Time : ০৬:১৮:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫
  • ৫৪৩ Time View

নানা পরিচয় তাঁর—শিক্ষক, সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা, টিভি ব্যক্তিত্ব, বইপড়া কর্মসূচির প্রণেতা, পরিবেশ রক্ষা উদ্যোগের অগ্রপথিক। গভীরে দৃষ্টি মেলে বুঝতে পারা যায়, এই সবগুলো আয়োজনের ভিত্তিটা একই—মানুষ। মানুষকে নিয়ে, মানুষের সঙ্গে। সবাইকে নিয়ে, সবার সঙ্গে।

লক্ষণীয়, অধ্যাপক সায়ীদের ব্যক্তিচরিত্রের অভিমুখটা শুরু থেকেই সংঘমুখী—বিচিত্র শ্রেণি-পেশা-বয়সের (নবীনই বেশির ভাগ) মানুষের অংশগ্রহণে একেকটা সংঘ কি সংগঠন তিনি গড়ে তুলেছেন। নিকটজনেরা জানেন, প্রতিটি সমবেত উদ্যোগে তিনি যেন প্রতিবার নতুন করে বেঁচে ওঠেন। পান নতুন প্রাণের সন্ধান। খুঁজে পান জীবনের নতুনতর অর্থ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রত্বের দিনগুলোতে ফিরে তাকানো যাক। বিদ্যান্বেষী, চিন্তাশীল, সাহিত্যপ্রিয় একদল সমদর্শী সহপাঠী-বন্ধুদের নিয়ে তিনি গড়ে তুললেন ‘নীরব সঙ্ঘ’। তাঁদেরই দু-চারজন যে কী ভীষণ একটা কাণ্ডের সূত্রপাত ঘটিয়ে বসেছিলেন, সেই ষাটের দশকের গোড়ায়, পরবর্তী সময়ে এ দেশের সংস্কৃতি জগতে তা এক কিংবদন্তি ঘটনার মর্যাদা অর্জন করে।

জানি না বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের ছাত্র তরুণ সায়ীদ নিজেও সেদিন জানতেন কি না—আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষত দেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কী অভূতপূর্ব একটি ঘটনাপরম্পরার সূচনা তিনি গুটিকয় বন্ধুকে নিয়ে করতে যাচ্ছেন—যা এ দেশের সব সংস্কৃতিসেবী ও সংস্কৃতিসংশ্লিষ্ট প্রত্যেক মানুষকে মাত্র বছর কয়েক পরেই শুরু হওয়া স্বাধিকার আন্দোলনে জোগাবে কিছুটা হলেও বাড়তি উদ্যম আর প্রেরণা।

ঘটনাটা জেনে নেওয়া যেতে পারে সেই ঐতিহাসিক আয়োজনের অন্যতম কুশীলব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের বয়ানে—

১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালনের প্রথম উদ্যোগ অবশ্য আমি গ্রহণ করি নি। তবে প্রাথমিক অবস্থা থেকেই আমি ছিলাম। দুজন তরুণ আমার কাছে এসেছিল। একজন পরে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে যথেষ্ট যশস্বী হয়েছে। সে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আর একজন মোশতাক, ভারিক্কি ধরনের চেহারা, চোখে পুরু লেন্সের চশমা, ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র ছিল। ওদের প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, হাসি হাসি ভাব আর চোখে-মুখে মনে হয় কিছু বলতে চাইছে, একটা মতলব নিয়ে এসেছে। হাবভাবে বোঝা যায়, আমাকে সম্পূর্ণ সত্য কথা বলবে না।

ওরা আমাকে বলল, স্যার, আমরা রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি। বিচারপতি মুর্শেদ (সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদ) কমিটি গঠন করবেন। তিনি সভাপতি হতে রাজি হয়েছেন। আপনাকে সম্পাদক হতে হবে। পরবর্তী সময়ে জেনেছিলাম বিচারপতি মুর্শেদের সঙ্গে তখনও ওদের আলোচনা হয় নি। আমাকে রাজি করানোর জন্যে এই কৌশল নিয়েছিল। যা-ই হোক, কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বুঝলাম ছেলেগুলো সিরিয়াস, যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে আটঘাট বেঁধে নেমেছে। ওদের কথার সুরে একটা ডেসপারেশন ছিল, বুঝলাম আমাকে রাজি হতেই হবে।…

এসব ছেলেদের সঙ্গে ছিল মনজুরে মওলা, আতাউল হক। এরা সবসময় নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত।…এ ব্যাপারে ঢাকা শহরের তিনটি উদ্যোগের কথা আমি জানি। একটি হলো কেন্দ্রীয় উদ্যোগ, যার প্রধান ছিলেন বিচারপতি মুর্শেদ আর একটি ছিল ডাকসুর উদ্যোগ, যার প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে সভানেত্রী ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। তৃতীয় উদ্যোগটি ছিল প্রেসক্লাবের। তারাও একটি বড় রকমের প্রোগ্রাম নিয়েছিল। আমাদের কমিটিতে কারা কারা ছিলেন তাদের সবার নাম আমার মনে নেই। যতদূর মনে করতে পারছি গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক হাই, নীলিমা ইব্রাহীম, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, এরা ছিলেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মোশতাক এমন সংকল্প করেছিল যে, প্রয়োজন হলে এই উৎসব করতে গিয়ে ওরা একটা একাডেমিক ইয়ার নষ্ট করবে। ছেলেগুলো একটা বিশেষ কঠিন সময়ে দারুণ কাজ করেছিল।…

[মনজুরে মওলা সম্পাদিত ‘শ্রাবণ’ সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ, যা পরবর্তী সময়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম-এ (১৭ জানুয়ারি ২০২০) এবং তারও পরে অধ্যাপক সায়ীদকে নিয়ে বিভিন্নজনের স্মৃতি-সংকলন ‘আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বহুমুখিতায় ও স্বপ্নচারিতায়’ (নালন্দা, ২০২১) গ্রন্থে প্রকাশিত।]

সামরিক শাসকের রোষদৃষ্টি উপেক্ষা করে মাত্র কজন বন্ধুকে নিয়ে এমন একটি আয়োজনের প্রত্যুৎপন্ন পরিকল্পনা যিনি করতে পারেন, বাকিটা জীবন যে তিনি নানা প্রকার সাংগঠনিক উদ্যোগে ব্যয় করবেন আর মানুষ এবং সংঘকেই করে তুলবেন নিজের মোক্ষ—বিচিত্র কী।

ব্যতিক্রম ঘটেনি। জীবনব্যাপী একে একে নানা রকম সংগঠন, সংঘবদ্ধ আয়োজন আর সাংগঠনিক কার্যক্রমকে যথার্থই নিজের চারণক্ষেত্র করে তুলেছেন সায়ীদ—সমষ্টির প্রয়োজনে এবং অবশ্যই জাতির মননটাকে আরেকটু উঁচুতে উত্তরণের লক্ষ্যে।

ট্যাগঃ

সংঘচারিতায় উজ্জ্বল আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

Update Time : ০৬:১৮:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫

নানা পরিচয় তাঁর—শিক্ষক, সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা, টিভি ব্যক্তিত্ব, বইপড়া কর্মসূচির প্রণেতা, পরিবেশ রক্ষা উদ্যোগের অগ্রপথিক। গভীরে দৃষ্টি মেলে বুঝতে পারা যায়, এই সবগুলো আয়োজনের ভিত্তিটা একই—মানুষ। মানুষকে নিয়ে, মানুষের সঙ্গে। সবাইকে নিয়ে, সবার সঙ্গে।

লক্ষণীয়, অধ্যাপক সায়ীদের ব্যক্তিচরিত্রের অভিমুখটা শুরু থেকেই সংঘমুখী—বিচিত্র শ্রেণি-পেশা-বয়সের (নবীনই বেশির ভাগ) মানুষের অংশগ্রহণে একেকটা সংঘ কি সংগঠন তিনি গড়ে তুলেছেন। নিকটজনেরা জানেন, প্রতিটি সমবেত উদ্যোগে তিনি যেন প্রতিবার নতুন করে বেঁচে ওঠেন। পান নতুন প্রাণের সন্ধান। খুঁজে পান জীবনের নতুনতর অর্থ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রত্বের দিনগুলোতে ফিরে তাকানো যাক। বিদ্যান্বেষী, চিন্তাশীল, সাহিত্যপ্রিয় একদল সমদর্শী সহপাঠী-বন্ধুদের নিয়ে তিনি গড়ে তুললেন ‘নীরব সঙ্ঘ’। তাঁদেরই দু-চারজন যে কী ভীষণ একটা কাণ্ডের সূত্রপাত ঘটিয়ে বসেছিলেন, সেই ষাটের দশকের গোড়ায়, পরবর্তী সময়ে এ দেশের সংস্কৃতি জগতে তা এক কিংবদন্তি ঘটনার মর্যাদা অর্জন করে।

জানি না বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের ছাত্র তরুণ সায়ীদ নিজেও সেদিন জানতেন কি না—আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষত দেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কী অভূতপূর্ব একটি ঘটনাপরম্পরার সূচনা তিনি গুটিকয় বন্ধুকে নিয়ে করতে যাচ্ছেন—যা এ দেশের সব সংস্কৃতিসেবী ও সংস্কৃতিসংশ্লিষ্ট প্রত্যেক মানুষকে মাত্র বছর কয়েক পরেই শুরু হওয়া স্বাধিকার আন্দোলনে জোগাবে কিছুটা হলেও বাড়তি উদ্যম আর প্রেরণা।

ঘটনাটা জেনে নেওয়া যেতে পারে সেই ঐতিহাসিক আয়োজনের অন্যতম কুশীলব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের বয়ানে—

১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালনের প্রথম উদ্যোগ অবশ্য আমি গ্রহণ করি নি। তবে প্রাথমিক অবস্থা থেকেই আমি ছিলাম। দুজন তরুণ আমার কাছে এসেছিল। একজন পরে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে যথেষ্ট যশস্বী হয়েছে। সে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আর একজন মোশতাক, ভারিক্কি ধরনের চেহারা, চোখে পুরু লেন্সের চশমা, ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র ছিল। ওদের প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, হাসি হাসি ভাব আর চোখে-মুখে মনে হয় কিছু বলতে চাইছে, একটা মতলব নিয়ে এসেছে। হাবভাবে বোঝা যায়, আমাকে সম্পূর্ণ সত্য কথা বলবে না।

ওরা আমাকে বলল, স্যার, আমরা রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি। বিচারপতি মুর্শেদ (সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদ) কমিটি গঠন করবেন। তিনি সভাপতি হতে রাজি হয়েছেন। আপনাকে সম্পাদক হতে হবে। পরবর্তী সময়ে জেনেছিলাম বিচারপতি মুর্শেদের সঙ্গে তখনও ওদের আলোচনা হয় নি। আমাকে রাজি করানোর জন্যে এই কৌশল নিয়েছিল। যা-ই হোক, কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বুঝলাম ছেলেগুলো সিরিয়াস, যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে আটঘাট বেঁধে নেমেছে। ওদের কথার সুরে একটা ডেসপারেশন ছিল, বুঝলাম আমাকে রাজি হতেই হবে।…

এসব ছেলেদের সঙ্গে ছিল মনজুরে মওলা, আতাউল হক। এরা সবসময় নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত।…এ ব্যাপারে ঢাকা শহরের তিনটি উদ্যোগের কথা আমি জানি। একটি হলো কেন্দ্রীয় উদ্যোগ, যার প্রধান ছিলেন বিচারপতি মুর্শেদ আর একটি ছিল ডাকসুর উদ্যোগ, যার প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে সভানেত্রী ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। তৃতীয় উদ্যোগটি ছিল প্রেসক্লাবের। তারাও একটি বড় রকমের প্রোগ্রাম নিয়েছিল। আমাদের কমিটিতে কারা কারা ছিলেন তাদের সবার নাম আমার মনে নেই। যতদূর মনে করতে পারছি গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক হাই, নীলিমা ইব্রাহীম, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, এরা ছিলেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মোশতাক এমন সংকল্প করেছিল যে, প্রয়োজন হলে এই উৎসব করতে গিয়ে ওরা একটা একাডেমিক ইয়ার নষ্ট করবে। ছেলেগুলো একটা বিশেষ কঠিন সময়ে দারুণ কাজ করেছিল।…

[মনজুরে মওলা সম্পাদিত ‘শ্রাবণ’ সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ, যা পরবর্তী সময়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম-এ (১৭ জানুয়ারি ২০২০) এবং তারও পরে অধ্যাপক সায়ীদকে নিয়ে বিভিন্নজনের স্মৃতি-সংকলন ‘আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বহুমুখিতায় ও স্বপ্নচারিতায়’ (নালন্দা, ২০২১) গ্রন্থে প্রকাশিত।]

সামরিক শাসকের রোষদৃষ্টি উপেক্ষা করে মাত্র কজন বন্ধুকে নিয়ে এমন একটি আয়োজনের প্রত্যুৎপন্ন পরিকল্পনা যিনি করতে পারেন, বাকিটা জীবন যে তিনি নানা প্রকার সাংগঠনিক উদ্যোগে ব্যয় করবেন আর মানুষ এবং সংঘকেই করে তুলবেন নিজের মোক্ষ—বিচিত্র কী।

ব্যতিক্রম ঘটেনি। জীবনব্যাপী একে একে নানা রকম সংগঠন, সংঘবদ্ধ আয়োজন আর সাংগঠনিক কার্যক্রমকে যথার্থই নিজের চারণক্ষেত্র করে তুলেছেন সায়ীদ—সমষ্টির প্রয়োজনে এবং অবশ্যই জাতির মননটাকে আরেকটু উঁচুতে উত্তরণের লক্ষ্যে।