০৯:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৮ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ওয়াক্‌ফ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে

  • Voice24 Admin
  • সময়ঃ ১২:০৩:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ৫৫১ Time View

ওয়াক্‌ফ হলো একধরনের পুণ্য বা সওয়াবের কাজ। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা, অভাবগ্রস্ত মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শন এবং নেক ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সহযোগিতা করা।

মানুষ যেহেতু নিজের সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব রাখে, তাই জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে তা ধর্মীয় সামাজিক বা অর্থনৈতিক যে প্রয়োজনই হোক না কেন, সেই সম্পদ ব্যয় করতে কোনো দোষ নেই। এখানে ওয়াক্‌ফের কয়েকটি প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য তুলে ধরা হলো। তবে এটিই একমাত্র তালিকা নয়।

১. ইসলামের প্রচার–প্রসার

এই উদ্দেশ্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো মসজিদ নির্মাণ। ইতিহাসের শুরু থেকেই মসজিদগুলো ইসলামের দাওয়াত, মানুষের শিক্ষা এবং চরিত্র গঠনের বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছে।

এই মসজিদগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর ইমাম–মুয়াজ্জিনদের ব্যয় নির্বাহের জন্য দোকান, বাগান ও বাড়িঘর ওয়াক্‌ফ করে দেওয়া হতো। বর্তমানে মসজিদের পাশাপাশি বিভিন্ন দাওয়াহ সেন্টার বা ইসলাম প্রচার কেন্দ্রও ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির আয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।

২. সামাজিক নিরাপত্তা ও সেবা

পারিবারিক ওয়াক্‌ফের মাধ্যমে নিজের সন্তান ও আত্মীয়স্বজনদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা হয়, যা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অন্তর্ভুক্ত। পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক ওয়াক্‌ফের মাধ্যমে সমাজের এতিম, মুসাফির ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সেবা দেওয়া হয়।

ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়া, গরিবদের পোশাক ও শীতের কাপড় দেওয়া এবং অসুস্থ, নিঃস্ব ও ভিনদেশি মুসাফিরদের সাহায্য করা ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।

৩. স্বাস্থ্যসেবা

এটি ওয়াক্‌ফের অন্যতম বিস্তৃত একটি খাত। অতীতে মুসলমানরা রোগীদের সেবার জন্য অসংখ্য ‘বিমারিস্তান’ (হাসপাতাল), স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করেছেন এবং চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা, যেমন রসায়ন ও ফার্মেসি এগিয়ে নেওয়ার জন্য সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ করেছেন।

৪. শিক্ষা বিস্তার

শিক্ষা ক্ষেত্রে ওয়াক্‌ফের অবদান এত ব্যাপক যে অল্প কথায় তা বলে শেষ করা যাবে না। গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ওয়াক্‌ফিয়া মাদ্রাসা ও স্কুল এর প্রমাণ।

বিশেষ করে বড় বড় মসজিদগুলোই ছিল শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র, যেমন মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদ, মিসরের আল–আজহার, মরক্কোর আল–কারাউইন, তিউনিসিয়ার আজ–জাইতুনা ও দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ। এ ছাড়া অগণিত লাইব্রেরি ও শিক্ষা ইনস্টিটিউট ওয়াক্‌ফের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৫. নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা

রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার কাজে ওয়াক্‌ফ করার ভিত্তি পাওয়া যায় বিখ্যাত সাহাবি হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)–এর ঘটনায়। তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য তাঁর বর্ম ও যুদ্ধের সরঞ্জাম ওয়াক্‌ফ করে দিয়েছিলেন।

৬. অবকাঠামো উন্নয়ন

জনসাধারণের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ, সেতু তৈরি ও সুপেয় পানির কূপ খনন করাও ওয়াক্‌ফের অন্তর্ভুক্ত। এর উদাহরণ হিসেবে মদিনায় হজরত উসমান (রা.) কর্তৃক রুমার কূপ ওয়াক্‌ফ করার ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ওয়াক্‌ফ ইসলামি অর্থব্যবস্থার এক অনন্য ও গতিশীল প্রতিষ্ঠান, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম উম্মাহর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে মেরুদণ্ডের মতো ভূমিকা পালন করেছে।

এটি যেমন সম্পদের সুষম বণ্টন বা সমাজসেবা, তেমনি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও পরকালীন মুক্তির বা ‘সদকায়ে জারিয়া’র এক শাশ্বত উপায়, যা দাতার মৃত্যুর পরও তাঁর আমলনামায় পুণ্য যোগ করতে থাকে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও জনকল্যাণে রাষ্ট্রীয় বাজেটের ওপর চাপ কমিয়ে ওয়াক্‌ফ আজও সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

তাই বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একটি আত্মনির্ভরশীল ও কল্যাণমুখী সমাজ গঠনে বিত্তবানদের ওয়াক্‌ফের সংস্কৃতিকে নতুন করে উজ্জীবিত করা এবং সাহাবায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই মহৎ ইবাদতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করা সময়ের একান্ত দাবি।

[email protected]

আবদুল্লাহিল বাকি : আলেম ও সফটওয়্যার প্রকৌশলী

ট্যাগঃ

টিভিতে আজকের খেলা (২২ ডিসেম্বর, ২০২৫)

ওয়াক্‌ফ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে

সময়ঃ ১২:০৩:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫

ওয়াক্‌ফ হলো একধরনের পুণ্য বা সওয়াবের কাজ। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা, অভাবগ্রস্ত মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শন এবং নেক ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সহযোগিতা করা।

মানুষ যেহেতু নিজের সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব রাখে, তাই জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে তা ধর্মীয় সামাজিক বা অর্থনৈতিক যে প্রয়োজনই হোক না কেন, সেই সম্পদ ব্যয় করতে কোনো দোষ নেই। এখানে ওয়াক্‌ফের কয়েকটি প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য তুলে ধরা হলো। তবে এটিই একমাত্র তালিকা নয়।

১. ইসলামের প্রচার–প্রসার

এই উদ্দেশ্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো মসজিদ নির্মাণ। ইতিহাসের শুরু থেকেই মসজিদগুলো ইসলামের দাওয়াত, মানুষের শিক্ষা এবং চরিত্র গঠনের বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছে।

এই মসজিদগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর ইমাম–মুয়াজ্জিনদের ব্যয় নির্বাহের জন্য দোকান, বাগান ও বাড়িঘর ওয়াক্‌ফ করে দেওয়া হতো। বর্তমানে মসজিদের পাশাপাশি বিভিন্ন দাওয়াহ সেন্টার বা ইসলাম প্রচার কেন্দ্রও ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির আয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।

২. সামাজিক নিরাপত্তা ও সেবা

পারিবারিক ওয়াক্‌ফের মাধ্যমে নিজের সন্তান ও আত্মীয়স্বজনদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা হয়, যা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অন্তর্ভুক্ত। পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক ওয়াক্‌ফের মাধ্যমে সমাজের এতিম, মুসাফির ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সেবা দেওয়া হয়।

ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়া, গরিবদের পোশাক ও শীতের কাপড় দেওয়া এবং অসুস্থ, নিঃস্ব ও ভিনদেশি মুসাফিরদের সাহায্য করা ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।

৩. স্বাস্থ্যসেবা

এটি ওয়াক্‌ফের অন্যতম বিস্তৃত একটি খাত। অতীতে মুসলমানরা রোগীদের সেবার জন্য অসংখ্য ‘বিমারিস্তান’ (হাসপাতাল), স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করেছেন এবং চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা, যেমন রসায়ন ও ফার্মেসি এগিয়ে নেওয়ার জন্য সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ করেছেন।

৪. শিক্ষা বিস্তার

শিক্ষা ক্ষেত্রে ওয়াক্‌ফের অবদান এত ব্যাপক যে অল্প কথায় তা বলে শেষ করা যাবে না। গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ওয়াক্‌ফিয়া মাদ্রাসা ও স্কুল এর প্রমাণ।

বিশেষ করে বড় বড় মসজিদগুলোই ছিল শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র, যেমন মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদ, মিসরের আল–আজহার, মরক্কোর আল–কারাউইন, তিউনিসিয়ার আজ–জাইতুনা ও দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ। এ ছাড়া অগণিত লাইব্রেরি ও শিক্ষা ইনস্টিটিউট ওয়াক্‌ফের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৫. নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা

রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার কাজে ওয়াক্‌ফ করার ভিত্তি পাওয়া যায় বিখ্যাত সাহাবি হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)–এর ঘটনায়। তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য তাঁর বর্ম ও যুদ্ধের সরঞ্জাম ওয়াক্‌ফ করে দিয়েছিলেন।

৬. অবকাঠামো উন্নয়ন

জনসাধারণের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ, সেতু তৈরি ও সুপেয় পানির কূপ খনন করাও ওয়াক্‌ফের অন্তর্ভুক্ত। এর উদাহরণ হিসেবে মদিনায় হজরত উসমান (রা.) কর্তৃক রুমার কূপ ওয়াক্‌ফ করার ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ওয়াক্‌ফ ইসলামি অর্থব্যবস্থার এক অনন্য ও গতিশীল প্রতিষ্ঠান, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম উম্মাহর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে মেরুদণ্ডের মতো ভূমিকা পালন করেছে।

এটি যেমন সম্পদের সুষম বণ্টন বা সমাজসেবা, তেমনি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও পরকালীন মুক্তির বা ‘সদকায়ে জারিয়া’র এক শাশ্বত উপায়, যা দাতার মৃত্যুর পরও তাঁর আমলনামায় পুণ্য যোগ করতে থাকে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও জনকল্যাণে রাষ্ট্রীয় বাজেটের ওপর চাপ কমিয়ে ওয়াক্‌ফ আজও সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

তাই বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একটি আত্মনির্ভরশীল ও কল্যাণমুখী সমাজ গঠনে বিত্তবানদের ওয়াক্‌ফের সংস্কৃতিকে নতুন করে উজ্জীবিত করা এবং সাহাবায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই মহৎ ইবাদতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করা সময়ের একান্ত দাবি।

[email protected]

আবদুল্লাহিল বাকি : আলেম ও সফটওয়্যার প্রকৌশলী